১৯ রমজান এক খারিজি (ইসলাম থেকে বিচ্যুত) সন্ত্রাসী কুফার মসজিদে ফজরের নামাজে ইমামতিরত অবস্থায় হযরত আলী (রাদি.)’র ওপর তরবারির আঘাত হানে। আর এই আঘাতের ফলেই আজ তিনি শহীদ হন। ফলে শেষ হয়ে যায় বিশ্বনবীর (সা.) পর ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসন।

উল্লেখ্য, বহু বছর আগে এক শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (রাদি.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে হযরত আলী (রাদি.)’র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,”হে আলী, এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। (আমি নিজেকে কল্পনা করছি) তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো (খোদায়ী) উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।”

মহানবীর জামাতা ও চাচাতো ভাই হযরত আলী (রাদি.) ছিলেন বীরত্ব, মহানুভবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। বেহেশতী নারীদের নেত্রী হযরতফাতিমা (রাদি.)-কে বিয়ে করার জন্য আবুবকর ও ওমরসহ অনেক সাহাবিই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে হযরত আলী (রাদি.)-কেই হযরত ফাতিমার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।

বিশ্বনবী (সা.)’র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী হযরত আলী (রাদি.)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল হযরত আলী (রাদি.)।

হযরত আলী (রাদি.) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক,  শুধু পার্থক্য হল হযরত হারুন (আঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।

হযরত আলী (রাদি.) এমন এক নাম যাঁর নাম উচ্চারণ ও যাঁর বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত।

বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী তার দরজা। অর্থাৎ বিশ্বনবী (সা)’র জ্ঞানের শহরে প্রবেশ করা সম্ভব নয় হযরত আলী (রাদি.)’র মাধ্যম ছাড়া। হযরত আলী (রাদি.) নিজেও বলতেন, কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যে বিষয়ে আমি রাসূল (সা)’র সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করিনি। বলা হয় বিশ্বনবী (সা) হযরত আলী (রাদি.)-কে এক হাজার বিষয় বা অধ্যায়ের জ্ঞান শিখিয়েছিলেন। আর এসবের প্রত্যেকটির ছিল এক হাজার শাখা। হযরত আলী (রাদি.) নিজেও বলতেন, আমাকে হারানোর আগেই যা কিছু জানার জেনে নাও, আমাকে যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কর না কেন আমি তার জবাব দেব।

হযরত আলী (রাদি.)’র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্ব কেবল মুসলিম কবি, সাহিত্যিক বা মনীষীদেরই প্রভাবিত করেনি, অমুসলিম পণ্ডিতরাও তার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপকতায় অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার প্রশংসা করে আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, হযরত আলী (রাদি.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ‍ব্যক্তি।

ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, “সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে হযরত আলী (রাদি.)’র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।”

ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)’র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন হযরত আলী (রাদি.)।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,

“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি

পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”

সাফীউদ্দীন হিল্লী (মৃ. ৮ম হিজরী) হযরত আলী (রাদি.) সম্পর্কে বলেছেন,

তোমার স্বভাব-চরিত্রের কমনীয়তা ভোরের মৃদুমন্দ সমীরণকেও করে লজ্জিত

 আর তোমার শক্তি ও সাহসের কাছে কঠিন পাথরও হয় বিগলিত

 তোমার মান-মর্যাদা এতটা মহান ও উচ্চ যে, তা কাব্যে করা যায় না প্রকাশ

আর না গণনাকারী তোমার গুণাবলী গণনা করতে সক্ষম।

মহানবীর জামাতা ও চাচাতো ভাই হযরত আলী (রাদি.) ছিলেন বীরত্ব, মহানুভবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। বেহেশতী নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমা (রাদি.)-কে বিয়ে করার জন্য আবুবকর ও ওমরসহ অনেক সাহাবিই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে হযরত আলী (রাদি.)-কেই ফাতিমার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।

হযরত আলী (রাদি.)’র জীবনের অনেক বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা বা মু’জিজা রয়েছে। যেমন, জন্মের সময় পবিত্র কাবা ঘরের  দেয়াল ভেঙ্গে আবার তা মিলিয়ে যাওয়া যাতে তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তাঁকে জন্ম দিতে পারেন, রাসূলের (সা.) ওফাতের পর কুবা মসজিদে রাসূল (সা.)-কে জীবিত অবস্থায় দেখানো, সূর্যকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয়া যাতে সঙ্গীরা নামাজ আদায় করতে পারেন সময়মত ইত্যাদি ।

ইবনে আব্বাস (রাদি.) বলেছেন:  মক্কা বিজয়ের পর ফেরার পথে এক রাতে মহানবী (সা.) হযরত আলী (রাদি.)-কে বলেন যে,  সূর্য যখন উদিত হবে তখন তুমি সূর্যের সঙ্গে কথা বলবে। আমি ফজলকে বললাম দেখবো আলী কিভাবে সূর্যের সঙ্গে কথা বলে। সূর্য ওঠার পর আলী (রাদি.) সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন: সালাম তোমায় হে সূর্য, তুমি আল্লাহর সৎ দাস ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে অবিচল।

সূর্য জবাবে বলল: ওয়া আলাইকাসসালাম হে  আল্লাহর রাসূলের ভাই!

আসমা বিনতে উমাইস বর্ণনা করেন হযরত ফাতিমা জাহরা (রাদি.) বলেছেন: কোনো এক রাতে হযরত আলী (রাদি.) ঘরে প্রবেশ করলে আমি ভীত হয়ে পড়ি। আসমা বলেন: হে বিশ্বের নারীকুলের নেত্রী! কিভাবে ভয় পেয়েছিলেন আপনি! তিনি বলেন: আমি শুনলাম যে জমিন বা মাটি আলীর সঙ্গে কথা বলছে এবং আলীও জমিনের সঙ্গে কথা বলছেন!

একবার হযরত আলী (রাদি.) একদল সঙ্গীসহ কুফার মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি ইমাম আলী (রাদি.) বলে: আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, আমি বিস্মিত যে এই দুনিয়া এই গ্রুপের হাতে রয়েছে এবং আপনি এই দুনিয়া থেকে কিছুই পাচ্ছেন না! হযরত আলী (রাদি.) বললেন, তুমি কি মনে কর আমরা (বিশ্বনবীর-সা. আহলে বাইত) যদি দুনিয়াকে চাইতাম তাহলে কী আমাদের দেয়া হত না? এরপর তিনি এক মুঠো পাথরের কণা হাতে নিয়ে সেগুলোকে মূল্যবান পাথরে পরিণত করে প্রশ্ন করেন-এসব কি? লোকটি বলল: সবচেয়ে মূল্যবান পাথর। আমরা দুনিয়া চাইলে তা দেয়া হয়, কিন্তু আমরা তা চাই না-এ কথা বলে তিনি সেগুলো দূরে ফেলে দেন এবং সেগুলো আবারও সাধারণ পাথরের কণায় পরিণত হয়!

এ ছাড়াও একবার বেশ কিছু সময় ধরে ভূমিকম্প হতে থাকলে ও পাহাড়গুলো কাঁপতে থাকলে লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হযরত আলী (রাদি.)’র শরণাপন্ন হন। হযরত আলী (রাদি.) সে সময় খলিফা ছিলেন না। তিনি ভূমিকে লক্ষ্য করে বলেন: তোমার কি হলো?  শান্ত হও। ফলে  ভূমিকম্প বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিস্মিত লোকজনকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন: “আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:

-যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন সে তার বোঝা বের করে দেবে। এবং মানুষ বলবে, এর কি হল ?

আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন জমিনকে বলবো, তোমার কি হলো? (এরপর কুরআনে এসেছে) সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে, ফলে আমার জন্য খবরগুলো বর্ণনা করবে জমিন।”

হযরত আলী (রাদি.)’র একদল সঙ্গী তাঁকে বললেন: মুসা ও ঈসা নবী জনগণকে অনেক মু’জিজা দেখিয়েছেন। আপনিও যদি সে ধরণের কিছু দেখাতেন তাহলে আমাদের হৃদয় সুনিশ্চিত হত। হযরত আলী (রাদি.) বললেন: তোমরা এ জাতীয় নিদর্শন দেখা সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু তারা বার বার একই অনুরোধ করতে থাকায় তিনি এক শুষ্ক উপত্যকায় একটি কবরস্থানের দিকে তাদের নিয়ে যান।  সেখানে তিনি দোয়া পড়ে ধীর কণ্ঠে বললেন: তোমার পর্দা সরিয়ে ফেল। ফলে হঠাৎ কিছু বাগান ও নহর বা খাল দেখা গেল একদিকে এবং অন্যদিকে জাহান্নামের আগুন দেখা যাচ্ছিল। একদল বলে উঠলো: যাদু যাদু। কিন্তু অন্য একদল এই মু’জিজাকে বিশ্বাস করে বললেন: বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: কবর হচ্ছে বেহেশতের বাগান অথবা জাহান্নামের গর্ত।

একবার জনগণ বৃষ্টির অভাবে হযরত আলী (রাদি.)’র কাছে গিয়ে নালিশ করায় তিনি দোয়া করলে সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। এতো বৃষ্টি হলো যে এবার জনগণ বলতে লাগলো: খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তিনি আবারও দোয়া করায় বৃষ্টি কমে যায়। (সূত্র: বিহারুল আনোয়ার)

বলা হয় একবার হযরত আলী (আ)-কে একইসঙ্গে ১৫০টি জটিল প্রশ্ন করা হয়েছিল। হযরত আলী (রাদি.) সব প্রশ্ন শোনার পর একে-একে সেসবের জবাব দিয়েছিলেন এবং একবারও প্রশ্নকারীকে বলেননি যে তোমার অত নম্বর প্রশ্নটা কি ছিল আবার বল! তিনি একনাগাড়ে এভাবে বলছিলেন যে, তোমার ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই, ২ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই… তোমার ১৫০ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই।

হযরত আলী (রাদি.)-কে জব্দ করার জন্য তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয় আপনি সেইসব প্রাণীর নাম বলুন যেগুলো ডিম পাড়ে ও যেগুলো বাচ্চা প্রসব করে। হযরত আলী (রাদি.) বললেন, যেসব প্রাণীর কান মাথার ভেতরে থাকে সেসব ডিম পাড়ে আর যাদের কান মাথার বাইরে থাকে সেসব বাচ্চা প্রসব করে। প্রশ্নকারীরা ভেবেছিল, হযরত আলী (রাদি.) এই জটিল প্রশ্নে উত্তর দিতে দিতে অনেক সময় নেবেন এবং সময়ের অভাবে সব প্রাণীর নাম বলতে পারবেন না। ফলে তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি জানেন না বলে অপবাদ দেয়া সম্ভব হবে!

আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (রাদি.)একবার যখন বলেছিলেন, আমাকে হারানোর আগেই যা কিছু জানার জেনে নাও, আমাকে যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কর না কেন আমি তার জবাব দেব। তখন এক ব্যক্তি  বললো, হে আলী! বলুন তো আমার মাথার কতটি চুল আছে ? হযরত আলী (রাদি.) বললেন, এটাও আমি বলতে পারব, কিন্তু এটা জেনে তোমার তো কোনো লাভ হবে না। অর্থাৎ এর মধ্যে তো উপকারী জ্ঞান নেই।

একটি বর্ণনায় এসেছে, সে যুগে ইরানের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ জুন্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় হযরত আলী (রাদি.)-কে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু হযরত আলী (রাদি.) তা সম্ভব নয় বলে জানান এবং বলেন যে, কোনো প্রশ্ন থাকলে তিনি তার জবাব দেবেন। উটের একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসা- যে রোগ এই জন্তুর শরীরে গর্ত সৃষ্টি করে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। হযরত আলী (রাদি.) জানান, কেবল ভারতের একটি উপাসনালয়ের একটি লোহার খুঁটি যা লোহা হওয়া সত্বেও তাতে আঘাতের ফলে সৃষ্ট শব্দ অন্য যে কোনো লোহার মধ্যে আঘাতজনিত শব্দের মত হয় না, তার স্পর্শই কেবল এ রোগ ভালো করতে পারে। বলা হয় ইউরোপীয়রা গবেষণার জন্য ওই খুঁটি নিয়ে যায় এবং আজো তার কোনো হদিস নেই।

রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায় হযরত আলী (রাদি.) নিকৃষ্ট ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করার বিদ্যাও জানতেন। কিন্তু তাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হত বলে তার প্রয়োগ করা তখনও সম্ভব হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here