মোহিতলাল মজুমদার
জন্ম ২৬শে অক্টোবর১৮৮৮
কাঁচড়াপাড়া, হালিশহর, চব্বিশ পরগণা, ভারত
মৃত্যু ২৬শে জুলাই১৯৫২
কলকাতা, ভারত
ছদ্মনাম ‘কৃত্তিবাস ওঝা’, ‘চামারখায়-আম’, ‘সব্যসাচী’, ‘সত্যসুন্দর দাস’, মধুকরকুমার কাঞ্জিয়াল’
পেশা কবি, সমালোচক, অধ্যাপক
জাতীয়তা  ভারতীয়
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি দেবেন্দ্র-মঙ্গল, স্বপন-পসারী, বিস্মরণী, আধুনিক বাংলা সাহিত্য

মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম : ২৬শে অক্টোবর১৮৮৮ – মৃত্যু : ২৬শে জুলাই১৯৫২) বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি এবং সাহিত্য সমালোচক। এছাড়াও তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবন্ধকার ছিলেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাব-গম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

প্রথম জীবন

মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই। মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়। তিনি চব্বিশ পরগণা জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি কিছুদিন কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তার রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো-তেরো বছর বয়সে পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন।

কর্মজীবন

বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল।[১] তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন।[২]

সাহিত্য প্রতিভা

মানসী পত্রিকাতে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত হয়। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তাঁর কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছুকাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য-সমালোচক হিসাবেও তাঁর সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল। কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন।

লেখার ধরণ

মোহিতলাল মজুমদার সৃজনধর্মী সাহিত্য সমালোচক ও প্রবন্ধকাররূপে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি একজন নিপুণ ও শব্দ সচেতন কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই তাঁর কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। নজরুল ইসলামের পূর্বে আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক প্রয়োগ তাঁর রচনায়ই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভাবে ও ভাষায় প্রচলিত কাব্যরীতিতে মোহিতলাল ছিলেন বিদ্রোহীস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যের দেহাত্মবাদী কবি হিসেবে তাঁর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ–

আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে।

প্রকাশনা জগৎ

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই বিতর্কিত সাহিত্য-প্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন। অনেক মাসিক পত্রিকায়, বিশেষ করে ভারতীতে কবিতা লিখতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। শনিবারের চিঠির নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’, ‘চামারখায়-আম’, ‘সব্যসাচী’, ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে লিখতেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা

কাব্যগ্রন্থ

  • দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯২২)
  • স্বপন-পসারী (১৯২২)
  • বিস্মরণী (১৯২৭)
  • স্মরগরল (১৯৩৬)
  • হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১)
  • ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন)
  • কাব্য মঞ্জুষা

তন্মধ্যে – ‘দেবেন্দ্র-মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন।

প্রবন্ধগ্রন্থ

  • আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬)
  • সাহিত্যকথা (১৯৩৮)
  • বিবিধ কথা (১৯৪১)
  • বিচিত্র কথা (১৯৪১)
  • সাহিত্য বিতান (১৯৪২)
  • বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫)
  • বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫)
  • জয়তু নেতাজী (১৯৪৬)
  • কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭)
  • সাহিত্য বিচার (১৯৪৭)
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here