শৈবাল বড়ুয়া |

যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ বিগত শতকের ষাটের দশকে ‘চাটগাঁ’ ছিল নিতান্তই মফস্বল শহর। আন্দরকিল্লা-কে ঘিরেই শহরের প্রাণচাঞ্চল্য। এর আশেপাশে লালদিঘি টেরিবাজার।

সরু রাস্তাগুলোতে ছিল কিছু রিক্সা, টমটম, গরু আর ঘোড়ার গাড়ি, আর ছিল ছোট বাস (যেগুলোকে স্থানীয়রা বলতো মুড়ির টিন)। তবে হাতে গোনা কিছু বিত্তশালীরা ব্যবহার করতেন যন্ত্র চালিত মোটরযান। কিন্তু সে সময় জনসংখ্যা কম হলেও মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। মনের গহীনে ছিল এক নিবিড় শান্তি।

সেদিনের কথা মনে পড়ে, আমার হাতে তখন ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’ একটি গল্পের বই। রঙিন প্রচ্ছদে অনেক ঘুড়ি উড়ছে স্বচ্ছ নীলাকাশের সীমানাহীন প্রান্তরে। প্রচ্ছদের ছবি দেখেই আমি মুগ্ধ! তখনই বইটা পড়ার জন্যে আমার তীব্র বাসনা জাগলো! আমার তখন

আঠারো বছর বয়েস। স্কুলের কিশোর বয়স পেরিয়ে সবেমাত্র কলেজের করিডোরে হাঁটছি আমি সদ্য এক তরুণ। বইটি পড়তে পড়তেই আমি হারিয়ে গেলাম নিঃসীম নীলিমায়। শূন্যে তখন বাহারি-রঙিন ঘুড়ির ছড়াছড়ি! গ্রন্থের গল্পগুলো গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করে সত্যিই আমি যেন অমৃতের স্বাদ পেলাম।

এই গল্পগ্রন্থের লেখক সুচরিত চৌধুরী। তিনি চাটগাঁর লেখক। অতএব তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার এক সুতীব্র বাসনা জাগল আমার মন প্রাণ জুড়ে। আমি তাঁর অন্বেষণে উদগ্রীব। জানলাম কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর আবাস চাটগাঁর বোস ব্রাদার্স সংলগ্ন রথের পুকুর পাড়। একদিন আমি নিজেই গিয়ে হাজির হলাম তাঁর আবাসের দোরগোড়ায়! তিনি ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, কাকে চাই? নির্বিকার আমি বললাম, আমি লেখক সুচরিত চৌধুরীর সাক্ষাৎ প্রার্থী। তিনি আলগোছে একটু হাসলেন। আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি বয়সে আমার চেয়ে বিশ বছর এগিয়ে। কিন্তু আমি তখনো আঠারো বছরে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ তখন তিনি প্রায় আটত্রিশ বছরের এক পরিপূর্ণ যুবক। তিনিই তখনো লিখে যাচ্ছিলেন ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’র মতো গল্প। তাঁর হাসিটি এক প্রচ্ছন্ন গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?

আমার পরিচয় আর কী দেবো! সেসময়ে পত্রিকার পাতায় দু’চার খানা লেখালেখি করি, কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী ছাড়া আর কিছুতো নয়।…বললাম তাঁকে। তিনি আমায় সদর কক্ষে বসালেন। আমি আর আমার উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, আমি আপনার আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়তে দেখেছি! সেই বইয়ের রেশ আমার মগজে গেঁথে গেছে। তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় আমায় বললেন, আরে আগে একটু চা-মিষ্টি মুখ হোক এরপর না হয় কথা বলা যাবে….!

আমি তখন ঢাকার পত্র-পত্রিকায় শিশু পাতার নিয়মিত লেখক। স্বাধীনতা পূর্বকালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার শিশু পাতার তৎকালীন সম্পাদক কবি আফলাতুন আমার কাছে জানতে চাইলেন চট্টগ্রামের লেখিকা সুরাইয়া চৌধুরীকে চিনি কিনা!

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কে এই লেখিকা? সেসময় শিশুপাতার ‘সাত ভাই চম্পা’র ক্যাপশন করেছেন পত্রিকার নিজস্ব চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ। সেসময় যাঁরা ওখানে নিয়মিত লিখতেন শিল্পী কালাম মাহমুদ তাঁর স্বকীয় মেধায় সব কবি-লেখকদের নাম নিয়ে ‘সাত ভাই চম্পা’ শিশুপাতায় সব নামগুলো লিখে একটি মজার ক্যাপশন তৈরি করলেন। যেটি পরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিসপ্তাহে নিয়মিত ছাপা হতো। সেখানে যেমন দেশের প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি সিকান্দর আবু জাফর, কবি সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখের নাম ছিল ঠিক তাঁদের পাশাপাশি ছড়াশিল্পী সুকুমার বড়ুয়া, সুরাইয়া চৌধুরী এবং আমি শৈবাল বড়ুয়া’র নামও ওই ক্যাপশনে গ্রথিত হলো।

কিন্তু তখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের লেখিকা সুরাইয়া চৌধুরীকে আমরা কেউ চিনি না। অথচ পত্র-পত্রিকা কিংবা সাময়িকীর পাতায় একই সাথে এক পৃষ্ঠায় সুচরিত চৌধুরীর লেখা। ঠিক অন্য পাশে আমার লেখা যুগপৎ ছাপা হয়েছে, সে অনেকবার ! কেননা সুরাইয়া চৌধুরীর লেখক পরিচিতি তখন পর্যন্ত কেউই জানতেন না। সাক্ষাতে আমি তাঁকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। তিনি এই একটি বিষয় সযতনে এড়িয়ে গেছেন আমাদের কাছে।

এই প্রশ্নগুলো যখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে ঠিক তখনই খোঁজ পেলাম ‘সুরাইয়া চৌধুরীর সেরাগল্প’, ‘শুধু চৌধুরীর শুধু কবিতা’ ‘একদিন একরাত’, ‘নদী নির্জন নীল’, ‘সুচরিত চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘কিংবদন্তীর গল্প : চট্টগ্রাম’ , ‘নির্বাচিত গল্প’ , এবং গানের সংকলন ‘সুরলেখা’ ইত্যাদি। তখনই বুঝলাম কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীই সুরাইয়া চৌধুরী ছদ্মনামেও লেখেন।

তাঁর সাহিত্য কীর্তিতে তাঁর পিতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এর সাথে সাংস্কৃতিক ধারায় তিনি বাঁশীতে সুর তুলে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। বিগত শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগে তাঁর সাথে চট্টগ্রাম বেতার ভবনে প্রায়শই দেখা হতো।

তাঁর রচনায় নিম্ন এবং মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন উঠে এসেছে পরম মমতায়। মানুষের জীবন মানের ক্ষেত্রে তাদের দুঃখ-বেদনা, রাগ-অনুরাগ, দ্রোহ এবং আর্তি নিরাভরণ-প্রাঞ্জল ভাষায় জীবনের জয়-পরাজয়কে জীবন্ত করে তুলেছে।

কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী তাঁর সাহিত্য কীর্তির জন্যে ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর জন্ম ২১ জানুয়ারি, ১৯৩০ এবং প্রয়াণ ৫ জানুয়ারি, ১৯৯৪ সাল। আমার সাথে তাঁর অসম বয়সী এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল যা আজ অব্দি অক্ষয় হয়ে আছে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে।

লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here