বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা বলতে মানুষ চিকিৎসা পরবর্তী সেবা বুঝলেও, চিকিৎসকরা একে স্বাস্থ্যসেবার একটি মাত্র অংশ বলে উল্লেখ করেছেন।

তারা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বা প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে যেখানে জনসংখ্যার হিসেবে চিকিৎসা সেবা সীমিত সেখানে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি এখনও কাগজে কলমে থেকে গিয়েছে বলে অভিযোগ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

ঢাকার মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা জিনাত শারমিন দুটি সন্তান জন্ম দেয়ার পর থেকে তার ওজন বাড়তে শুরু করেছে এবং সম্প্রতি করোনাভাইরাস পরবর্তী নানা জটিলতায় ভুগছেন তিনি।।

এমন অবস্থায় তার চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অর্থাৎ পরিমিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত শরীরচর্চার পরামর্শ দিয়েছেন। মিসেস শারমিন তার সুস্বাস্থ্যের এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হলেও সেটি মেনে চলা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“আমি যে এলাকায় থাকি এখানে হাঁটার তো রাস্তা নাই। ফুটপাথগুলো দখল হয়ে আছে। ফিটনেস সেন্টারগুলো এতো কস্টলি (দামী)। আমাদের মতো মিডেল ইনকাম (মধ্যবিত্ত) মানুষদের জন্য কঠিন, আর ধরেন বাসার কাছে কোন জিমে যদি যাই, একটা ড্রেসকোড থাকে। সেটা পরার পরিবেশও এখানে নাই,” বলেন তিনি।

জিনাত শারমিনের মতো এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আরও অনেকেই। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধুমাত্র অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া এবং ওষুধ খাওয়াকেই বুঝে থাকেন।

বাংলাদেশে মানসম্মত ব্যায়ামাগারের অভাবের অভিযোগ করেছেন অনেকে।

অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন হল অসুস্থতা ঠেকাতে আগে থেকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

এর সঙ্গে জুড়ে আছে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, ভেজালমুক্ত, পুষ্টিকর, সুষম খাবার খাওয়া এবং দুষণহীন মাটি পানি বাতাস নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশে এই ধরণের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ একেবারেই গড়ে ওঠেনি বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী।

“বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি কাগজে কলমে থাকলেও এটার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন, সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি একদমই নেই। খাবারে ভেজাল মেশানো হচ্ছে, বায়ু দূষণ হচ্ছে। এগুলো আমরা ভালো করতে পারছি না বলেই অসুখ বিসুখ হচ্ছে। আমরা ডায়রিয়ার জন্য হাসপাতালে বেড বাড়াচ্ছি। কিন্তু সুপেয় পানির ব্যবস্থা করছি না।”

স্বাস্থ্যসেবার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
স্বাস্থ্যসেবার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।

যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের ২০১৮ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার মান ও সহজপ্রাপ্যতার সূচকে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৩তম অবস্থানে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে যেখানে জনসংখ্যা অনুপাতে স্বাস্থ্যসেবা সীমিত সেখানে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে এবং সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে চিকিৎসা খাতে চাপ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন পুষ্টিবিদ তাসনিম হাসিন চৌধুরী।

“বাংলাদেশ তো স্বাস্থ্যসেবায় এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি। সেক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা অনেক জরুরি। এতে খরচও অনেক কম। এজন্য সবচেয়ে জরুরি প্রচারণা। যেমন সুষম খাবার খাওয়া, বয়স ভেদে শরীরচর্চা করা, পরিচ্ছন্নতা থাকা। এই বিষয়গুলো মিডিয়া প্রচার করতে পারে, সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বড় আর পাঠ্যবইয়ে এ নিয়ে উল্লেখ থাকতে পারে।”

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের শহুরে মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন নিয়ে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও এখনও পিছিয়ে আছে বিশাল গ্রামীণ সমাজের মানুষ। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রচারণার ওপর জোর দিয়েছেন মিস. চৌধুরী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারের স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য রেখেছে আমাদের বিশ্ব, আমাদের স্বাস্থ্য। অর্থাৎ এবারে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ করে মাটি পানি বায়ু বিশুদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশের দূষণ ঠেকানো গেলে সুস্বাস্থ্য অর্জন সম্ভব হবে সহজেই- বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here