চট্টগ্রাম ৮ আসনের সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদল আর নেই। ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ নবেম্বর বৃহস্পতিবার তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি দ্বিধাবিভক্ত জাসদের একাংশের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি ২ বছর আগে মস্তিষ্ক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগ সমস্যায়ও ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন। গত ১৮ অক্টোবর নিয়মিত চেকআপের জন্য তিনি ভারতের নারায়ণ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল। ৬৭ বছর আয়ু পাওয়া এই বিজ্ঞ অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটায় মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাঙ্গালুরুর এই হাসপাতালে বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠীর চিকিৎসাধীন ছিলেন এই সাংসদ। তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা এবং পরবর্তী কার্যবিধি সম্পন্ন করার ব্যাপারে পারিবারিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন। রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ সরকার তাঁর করণীয় সম্পর্কে সচেতন।
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জননেতার আকস্মিক মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন। দেশের অন্যান্য সাংসদ এবং উর্ধতন নেতারা শোক প্রকাশ এবং দেশ একজন সুযোগ্য নেতৃত্বকে হারাল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
চট্টগ্রাম-৮ আসন (চান্দগাঁও-বোয়ালখালি) থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এই রাজনীতিজ্ঞ বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তমনা, গণতান্ত্রিক, গণমুখী এই প্রাজ্ঞ জাসদ নেতা দেশ ও জাতির কল্যাণে তার আদর্শিক চেতনাকে বরাবর সমুন্নত রাখতেন।
এক সময়ের ছাত্রলীগ করা মইন উদ্দীন খান বাদল পরবর্তীতে নবগঠিত জাসদের সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক চেতনাকে সংহত করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া মইন উদ্দীন খান বাদল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান থেকে আসা অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে খালাসের সময় সশস্ত্র প্রতিরোধ করার নেতৃত্বেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এই সাহসী দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হলে প্রথমে জাসদ পরে বাসদ এবং বর্তমানে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে। ভাষা আন্দোলনের সেই বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে জন্ম নেয়া এই অকুতোভয় বাঙালী গণতান্ত্রিক চর্চায় সর্বদাই নিজেকে পরিশীলিত করতেন। তাঁর রাজনীতি ও সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার সময়গুলোতে উদার মানবিকবোধ, স্বাধীনচেতাই শুধু নন, মুক্ত চিন্তায় অন্যের মতামতকেও মূল্য দিতে পারতেন। দল-মত নির্বিশেষে প্রত্যেকের ব্যাপারে তার ছিল সহনশীল মানসিকতা। পরপর তিনবার নির্বাচনে জয়ী হওয়া এই সাংসদ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যে মাত্রায় বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, তা সবার নজরে পড়ত এবং অনেকেই প্রশংসায় হতেন পঞ্চমুখ। যথার্থভাবে বলতে গেলে একেবারে অনলবর্ষী বক্তার কাতারে তাঁর সম্মান। তিন পুত্র এবং এক কন্যাসন্তনের জনক মইন উদ্দীন খান বাদল ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াসে’ যুক্ত হওয়া বাদল একাত্তরে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি তাঁর দায়িত্বকে সর্বোতভাবে পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির চরম উত্থান, পতন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছরের দুঃশাসনে মইন উদ্দীন খান বাদল তাঁর আদর্শিক চেতনায় অনমনীয় থেকে জাসদের বাম সমাজতান্ত্রিক ঘরানার রাজনীতির বেড়াজালে একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। অন্তর্নিহিত কোন্দলে জাসদ-বাসদের বিভাজনে সামান্য দল বদল করলেও শেষ অবধি জাসদেই তাঁর রাজনৈতিক সীমানার গন্তব্য নির্ধারণ করেন। গণতান্ত্রিক চেতনায় উদার, মুক্ত চিন্তার চর্চা করা এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সবার কাছে গ্রহণীয় একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দশ বছরের সাংসদ জীবনের দলীয় ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় সমাসীন এই সদ্য প্রয়াত সাংসদের মৃত্যুতে জাতি একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। সমূহ ক্ষতি হলো স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার। তাঁর অন্তিম যাত্রা তাঁকে আবারও সকলের অন্তরের সীমাহীন শ্রদ্ধায় অভিষিক্ত করল। দেশ বুঝতে পারল দল-মত নির্বিশেষে মানুষের কাতারে দাঁড়ানো এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সচেতন দায়বদ্ধতায় সকলের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই নেতৃস্থানীয় বরেণ্য নেতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনাসহ রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল গভীর সমবেদনা।