কোম্পানি কমান্ডার এম এ বশর : আজ শুরু হল বাঙালির গৌরবের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি সকল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পাকিস্তানি হায়েনাদের পরাস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য। এই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন অনেক অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ বাঙালি। বিজয়ের এ মাসে ’৭১এর রণাঙ্গণের স্মৃতি নিয়ে দৈনিক পূর্বকোণে আজ থেকে প্রকাশিত হল ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’। প্রথম দিনে প্রকাশিত হল কোম্পানি কমান্ডার এম এ বশরের স্মৃতিচারণ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের বোয়ালখালী সংবাদদাতা সেকান্দর আলম বাবর।
মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের তালিকায় জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নানের নামের সাথে মিশে আছে বোয়ালখালীর এম এ বশরের নাম। তিনি ’৬৮-৭৭ পর্যন্ত দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম স্টিল মিলস্ ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশন (সিবিএ) এর নির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন।
পশ্চিম কধুরখীলে (বর্তমান পৌর ১নং ওয়ার্ড)। মা-বাবার ৫ জন পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনিই জ্যেষ্ঠ। বাবা মকবুল আহমেদ ছিলেন রেলওয়ে কর্মকর্তা। মা হাজেরা খাতুন গৃহিণী। বড় সন্তান হওয়াতে পরিবারের ভারও কম ছিল না তার কাঁধে। তারপরও দমে যাননি তিনি। দেশমাতৃকা আর শ্রমিকদের ভালবেসে আজীবন অধিকার আদায়ের সংগঠন আর সংগ্রাম করে গেছেন। বিয়ে করেন যুদ্ধের পর ’৭৩ সালে, রাউজানের উরকিরচরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের নুর জাহান বেগমকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এম এ বশর বলেন, আমার যুদ্ধ জীবনের সেরা যুদ্ধ ২৮ আগস্ট রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাদের বোয়ালখালীর মূল ক্যাম্প আক্রমণ। এ অপারেশনে আমরা প্রথমে সংগঠিত হয়েছিলাম জ্যৈষ্ঠপুরা সেনের বাড়ি। অপারেশনে কমান্ডার সোলায়মান বিএসসি। এখানে দুই শতাধিক মুক্তিকামী যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। আমরা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়েছিলাম। চার্জি গ্রুপে ছিলেন সুবেদার ফজলুল বারি, ওয়াজেদ, বেবি প্রমুখ। হেডকোয়ার্টারের সিঁড়িতে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করতে গিয়ে প্রথমে শহীদ হন সুবেদার ফজলু, বেবি। আহত হন ওয়াজেদ। ভোর ৪টার দিকে আমরা অপারেশন শেষ করি। পাকিস্তানি কিংবা রাজাকারদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা অনুমান করার সুযোগ ছিল না। রাত ৪টার দিকে আমরা স্থান ত্যাগ করি। পরে শুনেছি ওয়াজেদ বেঁচে ছিল। ক্যাম্প আক্রমণের খবর পেয়ে সকালে ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বোয়ালখালী আসে, ওখানে তারা গ্রেনেডের আঘাতে জর্জরিত ওয়াজেদকে পান, শেষ পর্যন্ত তাঁকে বেয়নেটের আঘাতে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেন। তিনি আরো বলেন, এ অপারেশনে আমরা কভারিং গ্রুপে ইপিআরকে রাখি, নেতৃত্বে ছিলাম আমি ও জানে আলম। অবস্থান ছিল ১৩নং পুলে। ওখানে দুটি মাইন পুঁতেছিলাম।
ধারণা ছিল আমরা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করলে উদ্ধারে রেলযোগে এগিয়ে আসবে পাকিস্তানি মিলিটারি। ওই পুলেই তাদের কবর রচনা হবে, ঠিকই তারা এসেছিল, দুভার্গ্য মাইন বিস্ফোরিত হয়নি। আমরা মিলিটারি ও তাদের রসদ বহনকারী ট্রেনটি আটকে দিতে পারিনি। তারপরও ক্যাম্পে থাকা বহু মিলিটারি আর রাজাকারকে আমরা হত্যা করেছি। তবে পুঁতে রাখা অপর মাইন ঠিকই বিস্ফোরিত হয় যখন মিলিটারি বহনকারী আরেকটি ট্রেন আসে। এতে প্রায় সকল মিলিটারিই নিহত হন। এটা সত্য থানা হোডকোয়ার্টার আক্রমণ করে বোয়ালখালীতে মিলিটারি আর রাজাকারদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলাম।
৩১ আগস্ট ভারতে ট্রেনিং নিতে চলে যাই। ত্রিপুরার প্যালাটোনায় ট্রেনিং নিই। প্রশিক্ষণের সময় ৪২দিন। ২২ নভেম্বর বোয়ালখালীতে এসে পৌঁছি। ইন্ডিয়া থেকেই আমাকে কোম্পানি কমান্ডার করা হয়।
এরপর ২৩ নভেম্বর রাঙ্গুনিয়া কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন চিড়িঙ্গা ক্যাম্প আক্রমণ করি। এতে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে নিহতের সংখ্যা এবং সম্পদ ক্ষয়ের পরিমাণ জানতে পারিনি। অবস্থান ছিল জ্যৈষ্ঠপুরা সেনের বাড়িতে। এরমাঝে রাজাকারদের ঘুমকে আমরা হারাম করে দিই। প্রায় প্রতিদিনই রাজাকারদের বাড়িঘরে হামলা করতাম। ১৪ ডিসেম্বর থানা হেডকোয়ার্টার থেকে মিলিটারি চলে যেতে বাধ্য হয়। বোয়ালখালী মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষণটি জীবনের সেরা মুহূর্ত, যা ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। তিনি গর্ব করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় সফলতা শহওে ও গ্রামে কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারা। তিনি স্বাধীনতার পর দেশগঠনে অংশ নিতে ফের স্টিল মিলের চাকরিতে যোগদান করেন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর জীবনে নেমে আসে নানা অত্যাচার নিপীড়ন। জেল, জুলুম, মামলা সবমিলে বাধ্য হন
প্রবাস জীবন বেছে নিতে। ’৭৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। জাতির জনকের কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ’৯৯ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
এরইমধ্যে কাতারে গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ। তিনি এ পরিষদের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। বর্তমানে বয়স ৭০ পার হলেও উপজেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ান মানুষকে সেবা দিতে। মানুষের কল্যাণ করার মানসে যুক্ত রয়েছেন একাধিক সংগঠনে।