করোনাভাইরাসের কারণে খেটে খাওয়া মানুষরা বড় বিপাকে পড়েছে। তাদের ঝুঁকিটা শুধু স্বাস্থ্যগত নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি জীবন ধারণের। যদিও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিটাও অন্যদের থেকে বেশি। তারপরেও করোনা মহামারীর কারণে নিম্ন আয়ের এ মানুষগুলো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে যতটা না উদ্বিগ্ন, তার থেকে বেশি উৎকণ্ঠিত ক্ষুধা নিবারণের জন্য।

সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ আমাদেরকে যদিও আশা যুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ‘ঘরে-ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ৬ মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে খুবই ইতিবাচক। করোনাভাইরাসের বর্তমান সংকটকালে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের বেশিরভাগই হারিয়েছেন কাজ। এই দুঃসময়ে রাষ্ট্র তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা এক বড় সুসংবাদ। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করবেন। একই সাথে আমাদেরও উচিত হবে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খেটে খাওয়া এবং অসহায়দের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষ হিসেবে আল্লাহপাকের কাছে সবাই সমান। কার ধর্ম কী তা পরের বিষয়, কেননা সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার ভুক্ত। কেউ বিপদে পড়লে আরেক জন তাকে উদ্ধার করবে এটাই ধর্মের শিক্ষা। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি এমনকি অপরাপর জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করাই হচ্ছে ধর্ম।

ধর্ম, মানুষের সুখ-শান্তি ও পথ প্রদর্শন এবং আলোর সন্ধান দিবার জন্য। ধর্মের মৌলিক অংশ দু’টি। প্রথমটি হলো আল্লাহর প্রতি মানুষের কর্তব্য। যেমন- নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি। আল্লাহর গুণ প্রকাশ, মহিমা কীর্তন ও তার পবিত্রতা ঘোষণা, তা আল্লাহর নির্দেশিত যে নিয়মেই হোক না কেন, তা মৌখিক ভাবে প্রকাশ, আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস এবং কার্যত প্রকাশ করলে সাধারণত আল্লাহর হক আদায় হয়।

দ্বিতীয়টি হলো মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ যা আদেশ দিয়েছেন তা পালনে মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে। মানুষের প্রতি মানুষের করণীয় যা আছে তা পালনে বান্দার হক আদায় হয়। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালবাসে, জীবন ধারণের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভর করে। একা কেউ তার সম্পূর্ণ প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ করতে পারে না। একে অপরের সহায়তা করবে এবং করে থাকে এটাই স্বাভাবিক।

কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির কেবল স্তূপীকৃত সম্পদ থাকলেই তার জন্য মহা প্রাসাদ গড়ে উঠবে না। সে জন্য তাকে রাজমিস্ত্রি হতে শুরু করে সাধারণ মজুরের প্রতি নির্ভর করতে হয়। তাই কাউকে ছোট বা হেয় করারও শিক্ষা ইসলামে নেই।

আমরা বিভিন্নভাবে বান্দার হক আদায় করতে পারি। আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তারা বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে পারেন। আবার যাদের জ্ঞান দিয়েছেন কিন্তু ধন সম্পদ দেননি তারাও পারেন মানব সেবা করতে। দেখা যায় গরিব ছেলেরা লেখাপড়া করতে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আবার প্রাইভেট শিক্ষকের নিকট পড়ার সামর্থ্যও তাদের হয় না। সম্পদশালীরা তাদের অর্থের দ্বারা এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের বিদ্যার দ্বারা তাদের সাহায্য করতে পারেন।

এক কথায়, ডাক্তার তার সেবা দ্বারা, বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে, লেখক তার লেখার মাধ্যমে, বিত্তশালীরা তার সম্পদ দ্বারা, বুদ্ধিমান তার বুদ্ধির দ্বারা, জ্ঞানী তার জ্ঞান দ্বারা, স্বাস্থ্যবান তার শক্তির দ্বারা সমাজের সেবা করতে পারে। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ স্থানে অন্যকে আলোর দিকে পথ দেখাই, সুপথের দিকে আহ্বান করি তাহলে অনেক অশুভ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। বিদ্যার দ্বারা জনসেবা করলে বিদ্যা কমে যায় না বরং তার বৃদ্ধি ঘটে, প্রদীপ্ত হয়ে উঠে। আল্লাহর প্রতিটি দান মানুষের উন্নতির জন্য। প্রয়োজন শুধু পরস্পর সহযোগিতার।

আগেকার দিনে দেখা যেত গ্রামাঞ্চলে মানুষ একখানা পত্র পড়ানোর ও লেখানোর জন্য কতই না সমস্যায় পরতে হত আর এর জন্য কাকুতি মিনতি করতেও দেখা যেত। যদিও এখন সেই অবস্থা নেই, তথাপি জ্ঞান বিতরণের অনেক সুযোগ রয়েছে।

কারো শরীরের কোনো অঙ্গ যদি আঘাত পায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সে কী আনন্দ পায়? বরং কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের এক অংশ ক্ষুধার্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, বস্ত্রহীন হলে অপর অংশ তাদের সাহায্যার্থে প্রাণঢালা সাহায্য করবে। তবেই সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ জাতি গড়ে উঠবে। আত্মতুষ্টির জন্যও সৃষ্টি সেবার প্রয়োজন রয়েছে।

বর্তমান করোনার কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার বসে আছে, এদের অধিকাংশই প্রতিদিনকার রোজগারে জীবিকা নির্বাহ করে। রাজধানীতে হকার রয়েছে কয়েক লাখের মতো। এদের মধ্যে রয়েছে ফুটপাথের চায়ের দোকানদার, পোশাক ও জুতা-স্যান্ডেল, বেল্ট, চশমাসহ ফুটপাথ ব্যবসায়ী, রাস্তাঘাটের বাদাম বিক্রেতা, পানি বিক্রেতা, ঝাল মুড়ি বিক্রেতা, চিপস বিক্রেতাসহ অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছে। যাদের অধিকাংশই প্রতিদিনের রোজগারে সংসার চালায়।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে রিকশা-ভ্যান ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। এদের অধিকাংশই প্রতিদিনের আয়ে সংসার পরিচালনা করে থাকে। এভাবে পোশাক শ্রমিকও রয়েছে বেশ কয়েক লাখ। এ ছাড়াও রাজধানী ও আশপাশে সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা, কাভার্ড ভ্যান, উবার, পাঠাও, ট্যাক্সিক্যাবসহ অন্যান্য পেশায় অসংখ্য মানুষ নিয়োজিত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগ দিন আনে দিন খায়। এসব পেশার সাথে আবার এমন কিছু লোকজন রয়েছে যারা সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন দিন চলতে পারবে। এরপর তাদের সংসার অন্য কারো সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই চালানো সম্ভব হবে না।

এসব খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই, বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় সেবামূলক কাজ করছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও শুকনো খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। যা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী হয়তো তা যথেষ্ট নয়। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আমার আশপাশের প্রতিবেশীর দিকে আমাকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমার কোন প্রতিবেশী যেন না খেয়ে রাত্রি যাপন করে সে বিষয়টি আমার নিশ্চিত করতে হবে। সৃষ্টির প্রতি আমার যে কর্তব্য রয়েছে তা আমাকে অবশ্যই আদায় করতে হবে।

প্রতিদিন সৃষ্টি সেবার কত সুযোগই না পাওয়া যায়, যেগুলো পালনের জন্য আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু আমরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করি না বরং অবহেলা করি, অবজ্ঞার চোখে দেখি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে অবহেলা করে স্রষ্টাকে তুষ্ট করা যায় না। মানুষের দুঃখ ও ব্যথায় ব্যথিত হয়ে, তাকে মনে প্রাণে অনুভব করে, তার প্রতিকার করার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে ধর্মের শিক্ষা।

প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকে তবেই সৃষ্টি সেবার মহান এক সংঘ গড়ে উঠবে। অপরের প্রতি অনুকম্পা, সহানুভূতি, উদারতা ও দয়া প্রদর্শন করা আজ আমাদের মৌলিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দয়া হতে দানশীলতার সৃষ্টি হয়। দানশীলতা ও সেবা করা মানবচরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য আর নির্দয় ব্যক্তি পাষাণবৎ।

অপরের অশ্রু দর্শনে যার হৃদয় বিগলিত হয় না, সে জনসেবার দাবি করতে পারে বটে, কিন্তু কার্যত কোনো উপকারই করতে পারে না। দুখীর দুঃখমোচন, বিপন্নকে উদ্ধার, শোকাতুরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা সৃষ্টি সেবার অন্তর্ভুক্ত। তাই আসুন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যার যার সামর্থ অনুযায়ী মানব সেবায় রত হই।

লেখক : মাহমুদ আহমদ, ইসলামি গবেষক ও কলাম লেখক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here