লিটন দাশগুপ্ত :

‘কালুরঘাট’ মানে কোন নদী বা পুকুরের ঘাট নয়, কিংবা কোন খাল পারাপারের সাঁকো নয়; ‘কালুরঘাট’ একটি সেতুর নাম। যার মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই কালুরঘাট সেতু দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের সাথে, চট্টগ্রাম শহর অঞ্চলের মানুষের অন্তরে নিরন্তর বন্ধন সৃষ্টি করেছে। বলতে গেলে কেবল চট্টগ্রাম শহর নয়, এই অঞ্চলের সাথে দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলের সংযোগ স্থাপন হয়েছে। কিন্তু এই সেতু এই অঞ্চলের মানুষের কাছে, এককালে যেমনই আর্শীবাদ হিসাবে ছিল, ঠিক তেমনই এইকালে এই এলাকার মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্শীবাদ বলছি এই জন্যে, যখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গ্রামগঞ্জের মানুষ শহরে আসা মানে স্বপ্ন ছিল, তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা (আমার পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধপ্রপিতামহ রেলওয়ে চাকুরী করতেন) দিনে এসে চাকুরী করে দিনেই গাড়ি করে বাড়ি ফিরে যেতে পারতেন কালুরঘাট রেলসেতুর বদৌলতে। অন্যদিকে অভিশাপ বলছি এই জন্যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, যেখানে প্রতিটি অঞ্চল যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ বিশেষ করে বোয়ালখালী উপজেলার লোকজন ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় একমুখী এই ব্রীজের সামনে এসে।

লিটন দাশগুপ্ত

সাধারণ মানুষের অবর্ণণীয় দুঃখ ও ক্ষতির কথা কেউ বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকার না হলে, লেখার মাধ্যমে কাউকে ভাষায় বুঝানো সম্ভব নয়। যেমন- অনেক সময় দেখা যায় হাসপাতালে নেয়ার পথে রোগী মারা যাচ্ছে, বিদেশগামী যাত্রীর ফ্লাইট মিস্ হয়ে যাচ্ছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীর বিয়ের লগ্নভ্রষ্ট হচ্ছে, শুক্রবার তথা জুম্মাবারে মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাযের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কাউকে কথা দিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছেনা, অফিস আদালতে কর্মকর্তা কর্মচারী কিংবা স্কুল কলেজের কি ছাত্র কি শিক্ষক যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারছেনা ইত্যাদি।
বৃটিশ আমলে আমরা বোয়ালখালীর মানুষ যখন গাড়ি করে অতি সহজে কম সময়ে ও দ্রæত গতিতে শহরে আসা যাওয়া করতাম, তখন পাশ্ববর্র্তী অন্যান্য উপজেলার মানুষ পায়ে হেঁটে, নৌকা সাম্মান চড়ে ধীরে ধীরে তাদের স্বপ্নের শহরে আসার চেষ্টা করতো। আর স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে যখন সেই সকল উপজেলার মানুষ, দ্রæত ও সহজে শহরের ভিতরে চলে আসছে, আর আমরা গাড়ি থাকার সত্তে¡ও তাদের আমলে নৌকা সাম্মানের মত শহরের বাইরে পড়ে আছি। অর্থাৎ আমরা সামনে ছিলাম এখন পিছনে পড়ে আছি, আর যারা পিছনে ছিল তারা এখন সামনে চলে এসেছে। বিষয়টি কোন অঞ্চলের মানুষকে প্রতিহিংসামূলক বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বলা নয়; একটি মাত্র কালুরঘাট সেতুর কারণে এই অঞ্চলের মানুষের অতীত বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুধাবনের জন্যে উল্লেখ করলাম মাত্র।

কালুরঘাট সেতু স্থানীয়ভাবে অর্থাৎ আমাদের কাছে ‘হালুরঘাডর ফোল’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, কালুরঘাট মানে পুকুর নদীর ঘাট নয়, কালুরঘাট একটি সেতুর নাম। তাহলে নামকরণে কেন এটি সেতু না হয়ে ঘাট হল! আর কালু’ই বা কে? তখনকার সময়ে কেনই বা এই সেতুর নির্মাণ প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল? এবার আসি এই সব কথায়। আমরা এখনকার সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা বোয়ালখালীর সর্বসাধারণ, যেভাবে একটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি, তখনকার সময়ের মানুষের সেই রকম প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে কিন্তু এই সেতু নির্মাণ করা হয়নি। সেতু নির্মাণের মূল কারণ ছিল, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনা করতে গিয়ে বৃটিশ সরকার, কর্ণফুলীর নদীর উপর একটি সেতুর অভাব অনুভব করেছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের প্রয়োজনে বা যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে একটি সেতু নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে, এবং সেই অনুযায়ী সেতুনির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে যুদ্ধাকালীন সময়ে ব্যবহারের জন্যে, ব্রিটিশ সৈন্যদের সুবিধার্থে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার কর্তৃক সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় নৌকার মাঝিমাল্লা ও জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন। যারা সাধারণ মানুষকে নৌকায় পারাপার করে এবং মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের ধারণা ছিল কর্ণফুলী নদীতে সেতু নির্মাণ হলে, তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ হুমকীর সম্মুখীন হবে। তৎকালীন সময়ে এতদঅঞ্চলে মাঝি ও জেলেদের নেতা ছিল ‘কালু’ মাঝি।

এলাকায় কুচকুচে কালো রঙের এই লোকটি অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী ছিল। ঐ সময় তার নেতৃত্বে স্থানীয় মাঝিমাল্লা জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ সংঘটিত হয়। তাদের আন্দোলনের মুখে সেতু নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ তীব্র বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ব্রিটিশদের সাথে পেরে উঠা কি সম্ভব? আন্দোলন চলাকালীন সময়ে হঠাৎ একদিন জলদাস সম্প্রদায়ের এই কালুমাঝি নিখোঁজ হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন পর কর্ণফুলী নদীর পূর্বাংশে, প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের জায়গাটিতে তার মৃত দেহ ভেসে উঠে। নেতার মৃত্যুতে আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়। এরপর ‘ব্রæনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া’ নামক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেতু তৈরীর আনুষ্ঠানিকতা ও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন সহজ হয়। অতঃপর ১৯৩০ সালে বর্তমান সেতুটি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়, এবং একই বছর জুন মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখ্য নৌকা পারাপারে কালুমাঝি’র নিয়ন্ত্রিত সেই ঘাটটিতে, কালুর প্রভাব প্রতিপত্তির জন্যে, তার নামানুসারে পুরো এলাকাটি কালুরঘাট পরিচিতি পায় এবং কালক্রমে সেতুটির নামও কালুরঘাট (হালুরঘাডর ফোল) হয়ে যায়। একমুখী এই সেতুটিতে প্রথম ২৮ বছর পর্যন্ত রেল চলাচল করলেও ১৯৫৮ সাল থেকে সব ধরণের যান চলাচলের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়।

এখন নির্মাণ সাল হতে হিসাব করলে দেখা যায়, বর্তমান কালুরঘাট পুলের বয়স ৯০ বছর। এমন বার্ধক্য বয়সে এসে এই সেতু ভারী যানবাহন আর বইতে পারছেনা, মানুষের অবজ্ঞাও সয়তে পারছেনা। তবে জন্মলগ্নে ফরমালিন ইথিলিন বিহীন ভেজালমুক্ত খাদ্যগ্রহণ করায় (সেতু তৈরীর উন্নত কাঁচামাল ব্যবহার করায়) উপরে দৈহিক সৌন্দর্য্য কিছুটা ¤øান হলেও ভিতরে কঙ্কালসার এখনো খুবই মজবুত শক্ত ও কঠিন। গত কয়েক মাস আগে নৌকা করে কর্ণফুলী নদী পারহতে গিয়ে এই কালুরঘাট সেতুর নিচের অংশ দেখলাম, এখনো অষ্টাদশী মেয়ের মত দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য যেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে!

যদিও ২০০১ সালে এই সেতুটি বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু সেই থেকে প্রায় ২০ বছর কেটে গেলেও এখনো রয়ে গেছে আগের মত। সেই হিসাবে বলা যায় আগামী আরো অনেক বছর নুয়ে নুয়ে বয়ে নিতে পারবে চলমান যানবাহনসমূহ।

এলাকায় যারা এই সেতু দিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করে তাদের মধ্যে আমিও একজন। তাই নিয়মিত যাত্রী হিসাবে লক্ষ্য করলাম, প্রায় নব্বই শতাংশ যাত্রী স্বমহিমায়, নিরব ভাবনায় গাড়ি করে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৌন থাকে। কিন্তু নীরব পথ পাড়ি দিলেও কালুরঘাট সেতু সংলগ্ন এলে তারা সরব হয়ে উঠে, কথা বলা শুরু হয়ে যায় কালুরঘাট সেতু নিয়ে। তখন যাত্রীদের মধ্যে দেখা যায় দ্বিধাদ্ব›দ্ব হয়ে দুই পক্ষে বিভক্ত হতে। একপক্ষ মনে করে এই জীবনেও এইখানে নতুন সেতু হবেনা। কারণ হিসাবে তাদের যুক্তি, চট্টগ্রামের সাথে আন্তঃজেলা সংযোগ হিসাবে নতুন ব্রীজ (শাহআমানত সেতু) করা হয়েছে, এছাড়া কালুরঘাট থেকে ৩৯ কিলোমিটার দুরে কর্ণফুলী ট্যানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়, তাই একটি মাত্র বোয়ালখালী উপজেলার সীমিত জনসাধারণের জন্যে এতটাকা ব্যয় করে সরকার স্বাভাবিকভাবে নতুন কোন সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করবেনা।

অপরদিকে অন্যপক্ষ মনেকরে সরকার সেতু না বানিয়ে যাবে কই; এই এলাকায় ব্রীজ নির্মাণ করতেই হবে। কারণ হিসাবে তাদের যুক্তি, চট্টগ্রাম দোহাজারী রেললাইন সম্প্রসারণ করে কক্সবাজার ঘুমধুম পর্যন্ত বর্ধিত করা হচ্ছে। আর রেল তো সেই কর্ণফুলী টানেল বা নতুন ব্রীজ (শাহআমানত সেতু) দিয়ে যাবেনা। তাই আন্তঃজেলা রেললাইন সংযোগ করতে হলে বাধ্য হয়ে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ করতেই হবে।

দুই পক্ষের কথা বিশ্লেষণ করে আমি বলতে পারি দুই পক্ষই সঠিক। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পর প্রায় বিশবছর কেটে গেলেও ঠিক আগের মত রয়ে গেছে সেই সেতু। এখনো দশ পনেরটি বগী নিয়ে রেলগাড়ি, ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস যাচ্ছে আর আসছে। অনেকের ধারণা যানবাহন সীমিত করলে আরো বিশ ত্রিশ বছর এইভাবে কেটে যাবে এই সেতু। তাই কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ না হলে এই মুহূর্তে এইখানে সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়।

আবার যেহেতু কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইন সম্প্রসারণ কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে, ইতোমধ্যে কক্সবাজারে ঝিনুক আকৃতি রেলস্টেশন নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে, আগামী ২০২২ সালে এই প্রকল্প উদ্বোধন হবার কথা। তাই সেই হিসাবে আশার কথা হচ্ছে, অচিরেই কালুরঘাট এলাকায় স্বপ্নের নতুন সেতু নির্মাণ হতে যাচ্ছে। তবে অত্র এলাকার সর্বসাধারণকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কর্তৃপক্ষ ‘সড়ক কাম রেল সেতু’র পরিবর্তে যদি কালুরঘাটের মত কেবল ‘রেল সেতু’ নির্মাণ করে, তাহলে নতুন সেতু হওয়া আর না হওয়ার মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য থাকবেনা। তখন সেই স্বপ্ন ও আশা প্রত্যাশা গুঁড়েবালিতে পরিণত হবে। যাহোক, পরিশেষে কালুরঘাট সম্পর্কিত আমার সামগ্রিক ভাবনা থেকে অভিমত ব্যক্ত করতে চাই।

ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, কোরিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেতুনির্মাণ সমীক্ষা চালানো হয়েছে। সর্বশেষ কোরিয়ান পরামর্শক প্রায় ১১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং ৮০০ কোটি টাকা সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া অত্র এলাকার সংসদ সদস্য জনাব মইন উদ্দিন খান বাদল মহোদয়, সেতু নির্মাণ নিশ্চিত না হলে ডিসেম্বরের মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে আজকের এইদিনে আমার এই লেখার মাধ্যমে, সেই ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন, প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক, প্রিয় কালুরঘাট রেলসেতুকে অগ্রীম চিরবিদায় জানিয়ে দিলাম। গুডবাই ব্রিটিশ শেষ স্মৃতিচিহ্ন কালুরঘাট সেতু, ওয়েলকাম এই এলাকায় আগতপ্রায় স্বপ্নের নিউব্রীজ।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here