চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিদায়ী চেয়ারম্যানের সঙ্গে দৃশ্যমান দূরত্ব থাকলেও নতুন চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এর মধ্য দিয়ে সিডিএ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মধ্যে সমন্বয়ের সূচনা হলো বলে মনে করছেন সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) দুপুরে এই সাক্ষাতে মেয়র চট্টগ্রাম নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য রক্ষায় সিডিএ’র উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন মেগাপ্রকল্প ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ বিশেষজ্ঞ মত নিয়ে পুর্নমূল্যায়নের অনুরোধ করেছেন। তবে সিডিএ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন- এই বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে তার কোনো আলাপ হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি তো বিশেষজ্ঞ নই, আমি একটা অপিনিয়ন দিয়েছি, যেটা চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যে এই আপত্তিটা উঠেছে। টাইগারপাস এলাকায় পাহাড়ের যে সৌন্দর্য আছে সেটা যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয়, সেটা আমি সিডিএ চেয়ারম্যানকে বলেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যাতে কোনো বিতর্ক না উঠে, সেজন্য বিশেষজ্ঞ মত নিয়ে সেটি পুর্নমূল্যায়নের অনুরোধ করেছি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র সাহেব সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে উনার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। আউটার রিং রোড নিয়ে কথা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ তো শুরু হয়ে গেছে। সেটা তো পুর্নমূল্যায়নের সুযোগ নেই।’
তবে বৈঠকে উপস্থিত সিডিএ’র বোর্ড সদস্য চসিকের কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘মেয়র এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে লালখানবাজারের পরিবর্তে শহরের বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে তৈরির অনুরোধ করেছেন। সেটা হলে টাইগারপাসের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যটা আছে সেটা রক্ষা পাবে বলে তিনি বলেছেন। এছাড়া সেটা দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই হবে। কারণ আগ্রাবাদ-চৌমুহনী সড়কে বক্স কালভার্ট আছে। বক্স কালভার্টের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করলে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ে আলাপ করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানিয়েছেন।’
গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিডিএ’র বাস্তবায়নাধীন এই এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার। চার লেইন বিশিষ্ট এই সড়কের প্রস্থ হবে সাড়ে ১৬ মিটার। নগরীর মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ফ্লাইওভারটি এই এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
দুই হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প সিডিএ বাস্তবায়ন করলেও এর অর্থায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যমান নকশায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ঘেরা টাইগারপাসের সৌন্দর্য্য ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছে ‘সেভ টাইগারপাস মুভমেন্ট’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। নকশা পরিবর্তনের দাবিতে সংগঠনটি বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, চট্টগ্রামের মেয়র এবং সিডিএ চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দিয়েছে। এর আগেও সংগঠনটি মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।
এছাড়া বিদ্যমান নকশায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়ন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও।
২০০৯ সালের ২৩ জুলাই রাজনৈতিকভাবে প্রথম নিয়োগ পাওয়া সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম চট্টগ্রাম মহানগরীর উন্নয়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
আবদুচ ছালাম গত ২৪ এপ্রিল বিদায় নিয়েছেন। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়র হিসেবে মনোনয়ন পেতে তোড়জোড় শুরু করেছিলেন ছালাম। কিন্তু মনোনয়ন পেয়ে মেয়র হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এরপর থেকে নাছিরের পরিচালনাধীন সিটি করপোরেশন এবং ছালামের পরিচালনায় থাকা সিডিএ’র মধ্যে দৃশ্যমান দূরত্ব তৈরি হয়। নগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ঘরোয়া সভায় দুই নেতার বাগবিতণ্ডার খবরও আসে গণমাধ্যমে। এর মাঝেই আকস্মিকভাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দুই নেতা পাশাপাশি বসে ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করার ঘোষণা দেন। দলের মধ্যে আলোচনা ছিল, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে মনোনয়নের আশায় ছালাম বসেছিলেন নাছিরের পাশে। কিন্তু এবারও বিফল হন ছালাম। সংসদ নির্বাচনের পর আবারও দুই মেরুতে চলে যান দুই নেতা।
তবে নতুন চেয়ারম্যান নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ যোগ দেওয়ার পর চসিক ও সিডিএ সমন্বয় করে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দুই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।
কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, বৈঠকে সিডিএ চেয়ারম্যান নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনসহ সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে মেয়রের সহযোগিতা চেয়েছেন। চেয়ারম্যান মহোদয়ও দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি মনে করি, দু’টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়েছে।’
জানতে চাইলে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে অতীতেও কোনো সঙ্কীর্ণতা ছিল না, এখনও নেই। আমাদের মধ্যে রেষারেষির কারণে যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ভেস্তে না যায়, মানুষ যাতে কোনো কষ্ট না পায়, সেটা দেখার অনুরোধ করেছি।’