ডা. বরুণ কুমার আচার্য
এক.
ইসলাম এমন জীবনব্যবস্থা, যার বিশ্ব সমাজ গড়ে তোলার ঔদার্য আছে। ইসলাম শুধু অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাই দেয়নি, তাদের সঙ্গে সামাজিক অংশীদারি, সৌজন্যবোধ ও মেলামেশার সুযোগ দিয়েছে।
ইসলামে অমুসলিমদের সঙ্গে ওঠাবসা ও কথাবার্তা বলা বৈধ। এমনকি প্রয়োজনে তাদের মসজিদে বসারও অনুমতি আছে। যখন সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি রাসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়েছে, তখন তারা মসজিদের শেষে গম্বুজের কাছে অবস্থান করে। যখন নামাজের সময় হলো, দলের একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজের সময় হয়েছে। এরা একদল অমুসলিম, তারা মসজিদে আছে। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘অমুসলিমদের কারণে জমিন নাপাক হয় না। ’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৫৭৬)।
অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়াও সুন্নত। নবী করিম (সা.) অমুসলিম রোগীদের দেখতে যেতেন এবং তাদের ঈমানের দাওয়াত দিতেন। তাদের সেবা করতেন। আনাস (রা.) বলেন, এক ইহুদি গোলাম নবী করিম (সা.)-এর খেদমত করত। যখন সে অসুস্থ হলো, তখন মহানবী (সা.) তাকে দেখতে গেলেন, তার মাথার দিকে বসলেন আর তাকে বলেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো! তখন সে তার পিতার দিকে দেখল। পিতা বলেন, তুমি আবুল কাসেমের অনুসরণ করো, ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন নবী (সা.) এই বলে বের হলেন, আল্লাহর শোকরিয়া, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। ’ (বুখারি, হাদিস : ১২৫৬)।
অমুসলিমদের জীবিতের যেমন হক রয়েছে, তেমনি মৃতেরও হক রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের দাফন বা সৎকারে সহযোগিতা করতে হবে। কেননা তারা শ্রেষ্ঠ মাখলুক তথা মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত। আবদুর রহমান ইবনে আবি লায়লা থেকে বর্ণিত, সাহল ইবনে হুনাইফ ও কায়েস ইবনে সাদ কাদেসিয়াতে বসা ছিলেন। তখন তাঁদের পাশ দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে কিছু লোক অতিক্রম করল। তখন তাঁরা দু’জন দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাঁদের বলা হলো, ইনি তো কাফির। তখন তাঁরা বলেন, মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একসময় এক জানাজা নেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো, এটা তো এক ইহুদির জানাজা। তখন তিনি বলেন, এটা কি প্রাণী নয় (মানব নয়)?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২১৩)।
মানব সমাজের মানুষগুলোর চিন্তাধারা ও কর্মপন্থা ভিন্ন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়াতে অপরাধের জন্ম দেয়। আর এ অপরাধগুলো দমনে আমরা সরকার ও পুলিশ বাহিনীর ওপর ছেড়ে দিয়ে আয়াতের বারণকে বারণ করে নিজেকে দায় মুক্ত করছি। এখানে ইসলামে তার প্রকৃত ধারনার বিবরণ বার-বার উল্লেখ রয়েছে।

দুই.
আলেম শব্দটি আমাদের কাছে সুপরিচিত। তারাই হলেন ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। যাদের আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের গভীর ইলম দান করেছেন। যাদের সবাই সম্মান করে। আর এই আলেম বলতে বুঝায় যিনি দ্বীন বা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত।
ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়- আলেমগণ দ্বীনি ইলম শিক্ষা করতে অনেক দূর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ইমাম আজম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ি, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সহ তাঁদের পূর্বে ও পরে কুরআন ও হাদিসের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে কি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমাজের কাছে এখন পর্যন্ত ইলমে দ্বীন পৌঁছিয়েছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যা আমরা তাদের অলংকৃত জীবনীতে পেয়ে থাকি।
এমন মহান ব্যক্তিত্বদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেকে উঁচুতে। সাধারণ মানুষের মাঝে তারা হলেন তারকারাজি তুল্য। যাদের অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ পেয়ে থাকে সঠিক পথের সন্ধান।
ওইসব আলেমের মর্যাদার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন।
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা আলেম; তারাই তাকে (আল্লাহকে) ভয় পায় ’ -সুরা ফাতিরের ২৮নম্বর আয়াত।
‘যাকে গভীর জ্ঞান দান করা হয়েছে; তাকে প্রভুত কল্যাণ দান করা হয়েছে’ -সুরা বাকারার ২৬৯ নম্বর আয়াত।
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে; অর্থাৎ আলেমগণ। আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দিবেন’ -সুরা মুজাদালার ১১ নম্বর আয়াত।
শুধুমাত্র পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন কেন? আলেমগণের মর্যাদার ব্যাপারে হাদিস শরিফে অসংখ্য স্থানেও আলোচনা রয়েছে। যেমন- রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আবেদের অপেক্ষা আলেমের মর্যাদা তেমন, যেমন তোমাদের সর্বাপেক্ষা ছোট ব্যক্তির তুলনায় আমার মর্যাদা। আল্লাহর রহমত বর্ষণ করেন মানুষের কল্যাণ শিক্ষাদাতার উপর। তাদের জন্য ফেরেশতারা, আসমান জমিন, গর্তের পিপীলিকা, এমনকি পানির মাছও দোয়া করে। [তিরমিজি : ২৬৮৫]
ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে আলেমগণের ভূমিকা রয়েছে। হাক্কানি ওলামাগণের সম্মান, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় আল্লাহ ও তার হাবিব (সা). এর সন্তুষ্টি হতে পারে। যাতে ব্যক্তি হবে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত ও প্রশংসিত।
আমাদের চলমানসমাজ আলেমদের দ্বারা উপকৃত হয়। তাদের দ্বারা সমাজের চারিত্রিক, আত্মিক, ধর্মীয় ও জ্ঞানগত চাহিদা পূর্ণ হয়। তাদের দ্বারা ইসলামী বিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধ, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক বন্ধন, ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকে থাকে। এ জন্য যে মানব সমাজে আলেম ও ইমামদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়, সে সমাজের মানুষ আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে, ভালো কাজের উদ্দীপনায়, সুপথ অনুসরণে এগিয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয়ে তাদের জ্ঞানগত দৈন্যতাও খুব কম থাকে।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম সমাজে যেসব পশ্চাৎপদতা, অনৈক্য ও ধর্মহীনতা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে তা থেকেও আলেমরাই তাদের রক্ষা করতে পারেন। তাঁরা দ্বিনি শিক্ষা, নৈতিকতা, আত্মিক পরিশুদ্ধি, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের বন্ধনে একত্র করতে পারেন সমগ্র মানব জাতিকে। এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে।

Gausia Huq Bhandari khanka sharif - פוסטים | פייסבוקতিন.
আল্লামা খায়রুল বশর হক্কানী যিনি বার আউলিয়ার চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার হাজী পাড়া গ্রামে ১৯৪৪ সালে ২১ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন এবং বর্নাঢ্য দ্বীনী জীবন ধারনে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও হাজারো আলেম প্রতিষ্ঠা করে ওস্তাজুল ওলামা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি সুফি ভাবধারার অনন্য গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে বিনয়, নম্রতা, উদারতা, সরলতা ও সুন্নিয়ত প্রচারে নিষ্ঠায় দ্বীনি শিক্ষার প্রচার প্রসারে ও মাইজভা-ারী দর্শনের সর্বত্র বিস্তৃতিতে নিজ অবস্থান থেকে ব্যাপক অবদান রেখে ৭সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ মঙ্গলবার মহান আল্লাহর সান্নিদ্যে গমন করেন।
আমার দৃষ্টিতে আল্লামা খায়রুল বশর হক্কানী ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক এবং সুফি ধারার একজন আলেম। তাঁর পান্ডিত্য মানব সমাজের নীতবিাক্যকে সকল জাতের মানুষের কাছে সহজ লভ্য করেছেন। তিনি মাইজভা-ারী ত্বরিকার পবর্ত্তক হযরত গাউসুল আজম শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (ক.) এর নাতি ও মাইজভা-ারী ত্বরিকার সরূপ উম্মোচক অছিয়ে গাউসুল আজম শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভা-ারী (ক.) এর বায়াত প্রাপ্ত ছিলেন। আমি মাইজভা-ারী ত্বরিকার একজন নগন্য অনুসারী হিসেবে তাঁর অনেক কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কথাবার্তা বলার সুযোগ হয়েছে। ধর্মীয় আলোচনা শুনার সুযোগ হয়েছে। তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। যেখানে আমি ধর্মান্ধতার কোন গন্ধ পায়নি। তিনি ইসলামের সুমহান বাণী দিয়ে মানব সমাজের সংস্কার ও কল্যাণের কথাই বার বার লিখেছেন বিভিন্ন কিতাবাদি থেকে। আজীবন তিনি দ্বীন শিক্ষার প্রসার, সুন্নিয়ত ও তরিকতের খেদমতে নিবেদিত ছিলেন। তাই আল্লামা হক্কানী (রহ.) অসাধারণ গুণ চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন। সরলতা, সততা, উদারতা, বিনয় ও পরার্থপরতার বিরল গুণ ছিল তাঁর মাঝে। আর সেকারণে তিনি অসা¤্রদায়িতায় জনন্দিত হয়েছেন। কর্মগুণেই তিনি মানব সমাজে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
দ্বীন শিক্ষার প্রসার, সুন্নিয়ত ও তরিকতের খেদমতে নিবেদিত থেকে অসামান্য কর্মমুখরতার স্বাক্ষর রেখেছেন আজীবন । তিনি আশেকানে আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, আশেকানে আউলিয়া কলেজ ও উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লামা হক্কানী (রহ.) জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। অসাধারণ কর্মকীর্তিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগ যুগ ধরে।

পরিশেষ, আল্লামা হক্কানী (রহ.) দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করে সমাজে যে আলো বিলিয়ে গেছেন তাঁর সমকক্ষ হয়তো আমরা আর কাউকে পাবো না কিন্তু আমরা চাই ইসলামের সুমহান সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতির চেতনা যেন যুগের আলেম সমাজরাই জিইয়ে রাখেন মানব সমাজের তরে। যেখান থেকে মানুষ উপলব্দি করতে পারে ধর্মান্ধতা জীবনকে কুলষিত করে এবং ¯্রষ্টার নৈকট্য থেকে দূবে রাখে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here