: আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবিত কালুরঘাট সড়ক ও রেল সেতুর কাজ শুরু না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল। সাংসদের এমন আল্টিমেটামে অনেকের ধারণা, হয়তো শিগগরিই শুরু হবে সড়ক ও রেল সেতু। কিন্তু সেতু নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের যে নির্দেশনা, তাতে এ বছরেই নতুন কালুরঘাট সেতুর কাজ শুরুর কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে দেরিতে হলেও কালুরঘাটে সড়ক ও রেলের দুটি পৃথক সেতুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

গত বছর একনেক থেকে ফেরত যাওয়া এ প্রকল্পটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক সভাপতি শেখ হাসিনার বিশেষ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা মানতে হলে নতুন করে আবার শুরু করতে হবে সমীক্ষাসহ প্রকল্পের যাবতীয় কাজ। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, সেতুটি নিয়ে টেকনিক্যাল পথে না গিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক তদবির করতে হবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর জরুরি নির্দেশনাই এ বছরের মধ্যে হতে পারে কালুরঘাট সড়ক ও রেল সেতুর কাজ।

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আগের প্রস্তাবিত কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুটি থেকে সরে এসেছে রেলওয়ে। এখন নতুন করে শুধুমাত্র ডেডিকেটেড দুই মুখী রেল সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যেটি হবে ব্রডগেজ রেল সেতু। ইতোমধ্যে কোরিয়ান দাতা সংস্থা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দাতা সংস্থাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

খুব কম সময়ের মধ্যেই রেল ভবনের চাহিদামত ডেডিকেটেড দুই মুখী রেল সেতুর কাজ শুরুর জন্য নতুন করে সমীক্ষাসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কাজ শুরুর কথা রয়েছে ইডিসিএফের। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতু ভেঙে নতুন করে পৃথক রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভুক্ত।

তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদলসহ স্থানীয়দের দাবি ঝুঁকিপূর্ণ মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট রেল সেতুর বদলে নতুন করে সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যে পথে এগোচ্ছে তাতে সড়ক সেতুর কোনো হদিসই নেই। দেশের বড় বড় সেতু নির্মাণ করে থাকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু কালুরঘাটে নতুন সড়ক সেতু নির্মাণের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি বলে জানা গেছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে কালুরঘাটে নতুন সেতুর বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একনেক থেকে কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতু প্রকল্পটি ফেরত আসার সময় প্রধানমন্ত্রীর কিছু নির্দেশনাও ছিল। সেই নির্দেশনা মত আমরা ডেডিকেটেড দুই মুখী রেল সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছি। ইতোমধ্যে কোরিয়ান দাতা সংস্থার সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে কয়েক দফা। তারাও আমাদের চাহিদামত সেই পথে এগোচ্ছে।’ নতুন রেল সেতুর সমীক্ষা যাচাইসহ সব ধরনের পেপারওয়ার্ক শেষ করতে আনুমানিক আরও এক বছরের বেশি সময় লাগবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

পদাধিকারবলে এ প্রকল্পটির পরিচালক হয়ে থাকেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী। জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল জলিল বলেন, ‘আগের প্রকল্পটি একনেক থেকে ফেরত আসার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মত আমাদের রেল ভবন কাজ করছে। বর্তমান বিষয়টি সম্পূর্ণ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই আমার জায়গা থেকে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা দুই মুখী ডেডিকেটেড রেল সেতুর জন্য ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার দাতা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারাও সেই পথে এগোচ্ছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য দিতে পারবেন ডিজি স্যার বা মন্ত্রী মহোদয়।’

কর্ণফুলী নদীর ওপর বর্তমানে দুটি সেতু রয়েছে। কালুরঘাট রেল সেতুর পাশাপাশি ভাটায় শাহ আমানত সেতু ঠাঁই দাঁড়িয়ে কর্ণফুলীর বুকে। যদিও নতুন শাহ আমানত সেতুর বিরোধিতা করেছিলেন তৎকালীন মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

তার যুক্তি ছিল, কর্ণফুলীতে পিলার সেতু হলে নদী নাব্যতা সংকটে পড়ে ভরাট হয়ে যাবে। বাধাগ্রস্থ হবে বন্দরকেন্দ্রিক জাহাজ চলাচল। পরে মহিউদ্দিনের দাবির প্রেক্ষিতে ওই সময়ে শাহ আমানত সেতুর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনটি পিলার থাকার কারণে কর্ণফুলীর নাব্যতা সংকট হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের লাইফলাইন বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী। ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিতে হয়েছে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে।

এমনকি একনেক থেকে ফেরত আসা কালুরঘাট সড়ক ও রেল সেতুর সমীক্ষা যাচাইয়ের সময়ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আপত্তি ছিল। সেই সময় বন্দরের আপত্তির মুখে বর্তমান ব্রিজ থেকে আরো দশ মিটার উঁচুতে ডিজাইন করা হয়েছিল ব্রিজটির। এখন প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতে যদি কালুরঘাটে সড়ক ও রেলের জন্য পৃথক দুটি সেতু হয় তখন কর্ণফুলীর নাব্যতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্থানীয় সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘সেই প্রশ্নটিও আমার। আগের প্রস্তাবিত সেতুটি হলে রেলের পাশাপাশি যানবাহনও চলাচল করতে পারতো। পুরানো সেতুটি উচ্ছেদ করা হলে নদীর নাব্য সংকটের আশংকা থাকতো না। এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কথা বলে রেলওয়ে যে পথে এগোনোর কথা বলছে তা আমার বোধগম্য নয়।’

দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্রিজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে মইন উদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে নির্মিত পরিত্যক্ত কালুরঘাট সেতু দিয়ে বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক উপজেলার লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন যাতায়ত করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেতু পারাপারের জন্য রোগীসহ হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করেন। গত দশ বছর ধরে এ সেতু নির্মাণের কথা উঠছে। কিন্তু কোন্ অদৃশ্য কারণে সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে না তা এখন এলাকাবাসী জানতে চায়।’

বাদল আরো বলেন, ‘কালুরঘাট ব্রিজ নির্মাণ নিয়ে বিড়ম্বনা দুঃখজনক। এটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি, জনদাবি। এ সেতু অবিলম্বে নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকে আর কত আশ্বাস দেবো? তারা এখন বাস্তবায়ন দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সাল ও ২০১৪ সালে দুই বার এ সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেতুর জন্য আমি এলাকায় গেলে জনগণের তোপের মুখে পড়ি। সেজন্য বাধ্য হয়েই সংসদে ঘোষণা দিয়েছি ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর বিষয়ে কোনও সুরহা না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করব।’

এটি শুধু কথার কথা নয়, জনগণের দাবি পূরণ না হলে সংসদ থেকে শুধু পদত্যাগ নয়। এমনকি জাত পাত দলও পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের যোগদান করার কথাও জানান বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত মইন উদ্দিন খান বাদল।

এদিকে কালুরঘাটে ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন সেতু নির্মাণের দাবিতে জন দাবি ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। সেতু নির্মাণের দাবিতে গত সোমবার (১ জুলাই) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেছে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ নামে একটি সংগঠন। একই দাবিতে গত শনিবার (৬ জুলাই) কালুরঘাট সেতুর পূর্ব পাড়ে অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন বোয়ালখালীর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ। এতে সংহতি জানিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অনশন ভাঙিয়েছেন চট্টগ্রাম ৮ আসনের সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল।

জানা গেছে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনার জন্য ১৯৩০ সালে কর্ণফুলী নদীতে একটি আপৎকালীন সেতু নির্মাণ করা হয়। ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে ৭০০ গজের সেতুটি তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মোটরযান চলাচলের জন্য সেতুতে ডেক বসানো হয়। ১৯৫৮ সালে এই এক লেনের সেতুটিই সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ এই সেতু। ফলে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। এ অবস্থায় সেতু ব্যবহারকারী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের বাসিন্দারা একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান নতুন সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট রেল ও সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এবং বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেল সেতু ভেঙে নতুন করে রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভুক্ত।

সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাট কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল ও সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে ঢাকাস্থ রেলভবন কার্যালয়ে পাঠায়। পরে সেটি যাচাই-বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করে ২৭ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়।

প্রকল্প অনুসারে ২০২০ সালের শুরুতে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

রেল কর্মকর্তাদের মতে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের যে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, তার সুফলও নির্ভর করছে কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের ওপর।

তথ্য সূত্র: চট্টগ্রাম প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here