বিশ্বজিৎ রায় :

রবীন্দ্রনাথ এখন বেঁচে থাকলে এবং যে কথাগুলি সে-কালে বলেছিলেন এ-কালে তা বললে কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে ভোটের মরসুমে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলে বকুনি খেতেন সন্দেহ নেই। রবি ঠাকুর অবশ্য কেবল ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ তকমাতেই খারিজ হতেন না, ‘অ্যান্টিকমিউনিস্ট’ বলেও ঘোষিত হতেন। রবি ঠাকুরের মুশকিল হল তাঁকে কেটে-ছেঁটে সাইজ় করা যায় না। এক দিকে নেশনবাদী, মিলিটারিপন্থী, পুঁজিবাদীদের তিনি কচুকাটা করেছেন। সেই সব যুক্তি অনুসরণ করলে মনে হবে তিনি বুঝি বামমার্গী। আবার আগমার্কা বামধর্মের বিরোধী কথাবার্তাও তো তাঁর লেখাপত্রে কিছু কম নেই। তা হলে তিনি কোন দল? কোনও একটা ছাঁচে বন্দি থাকার বান্দাই যে তিনি নন।

বিশ শতকের শুরু। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন  ‘‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে/ অস্ত গেল …জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়/ ধর্মেরে ভাসাতে চায় বলের বন্যায়।’’ এই শতকেই দুই বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা বিশ্বযুদ্ধের আগে লিখছেন বটে, তবে পশ্চিমের জাতিরাষ্ট্রগুলির চেহারা-চরিত্র ঠিকই টের পেয়েছিলেন। পদ্যের ভাষার থেকে তাঁর গদ্যের ভাষা ছিল আরও ধারালো। ‘বিরোধমূলক আদর্শ’ (আশ্বিন ১৩০৮) প্রবন্ধে লিখলেন, ‘মিলিটারিত্বের রক্তিমায় য়ুরোপের’ গাল টকটকে হয়ে উঠছে। ‘ন্যাশানালত্বের ব্যাধি’ তার হৃদয়, মর্ম ও ধর্মকে দখল করছে। তাঁর থেকে বয়সে বড় বঙ্কিমচন্দ্র বিশ-শতকের চেহারা দেখেননি, একটু ছোট বিবেকানন্দ শতকের গোড়ায় প্রয়াত, নেশনের তাণ্ডব বুঝতে পারেননি। এই দুই বাঙালি যাকে দেশ গড়ার হাতিয়ার ভাবতেন সেই নেশনবাদ যে ‘বলের বন্যায়’ ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব স্বরকে স্তব্ধ করে দিতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন। যাঁরা রাবীন্দ্রিকতায় বিশ্বাস করবেন, তাঁরা ‘মিলিটারিত্ব’ ও ‘ব্যাধিগ্রস্ত ন্যাশানালত্ব’, দুই উগ্রধর্মের ধোঁয়ায় বুঁদ হতে পারেন না। তাই বলছিলাম, এই সব কথা রবীন্দ্রনাথ যদি এখন বলতেন? হালের ভক্তরা কি তাঁকে ছেড়ে কথা কইতেন? সে-কালেও চিনে, জাপানে, আমেরিকায় যখন রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ন্যাশনালত্বের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন, সেখানকার মানুষ তাঁর ওপরে বেজায় খাপ্পা হন। পরাধীন দেশের কবি, তার আবার বড় বড় কথা! রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নিজের কথা ফিরিয়ে নেননি। বিষয়টি ইংরেজিতে বলেছিলেন, কারণ শুধু বঙ্গবীরদের নয়, পৃথিবীর দেশখ্যাপানিয়াদেরও সাবধান করতে চান তিনি।

কেন সাবধান করতে চান? কারণটি অতি বাস্তব— নিজের কোলে সব ঝোল টানতে চাইলে কিন্তু নিজেই শেষে বিপদে পড়বে। অর্থনীতির যুক্তি দিয়েই বোঝাতে চাইছিলেন বিষয়টি। মুষ্টিমেয় মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদাকে কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করে সে চাহিদা মেটাতে বাকি সব কিছু জলাঞ্জলি দেওয়াই পুঁজিবাদী নেশনতন্ত্রের লক্ষ্য। দানবীয় মিলিটারিত্ব তার অস্ত্র। বিশের দশকের বিভিন্ন প্রবন্ধে ফিরে ফিরে আসছিল একই কথা। প্রয়োজনের তুলনায় চাহিদাকে কৃত্রিম উপায়ে বহু গুণ করে তোলার ফলে গোটা বিশ্বে দেখা দিয়েছে অসামঞ্জস্য। এক প্রান্তে আছে চাহিদাতাড়িত স্বল্পসংখ্যক মানুষ। ভোগ-দখলের অংশী তারাই। যেমন মিলিটারি-বহুল নেশন নিজের লালসা মেটাতে অপরকে দখল করে, তেমনই এই মানুষেরা বিত্ত ও ভোগবাসনাকে অলস ব্যক্তিগত উপভোগের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। এতে বঞ্চিত বিপুলসংখ্যক মানুষের কী হয়? সমাজে ঈর্ষা, শ্রেণিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। প্রকৃতি ও পৃথিবী নিঃস্ব হয়ে যায়।

পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে কি, রবি ঠাকুর থাকলে এই মরা বামপন্থার পক্ষে তাঁকে কোনও কেন্দ্র থেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যেত? না, তা হবে না। পার্টি লাইনের অমোঘ ঠুলি পরে থাকা বামপন্থীদের অনেক কিছুর সঙ্গেই যে তাঁর বেমিল। রবীন্দ্রনাথ সেই পার্টি লাইনের সব কিছু মেনে নিতেন না। ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার থাকা উচিত কি না, সমাজতন্ত্রের এই গোড়ার প্রসঙ্গটিতেই যে রবীন্দ্রনাথ বামেদের থেকে অন্য রকম করে ভেবেছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় রবীন্দ্রনাথকে সমাজবাদী বলে মনেই করতেন না। পুঁজিবাদের সমালোচনা করছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁর মতে ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণার বিলোপসাধন সমাধান নয়। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত সম্পদের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের যোগ আছে। কাজেই ব্যক্তিসম্পদের বিলোপসাধন করলে মানুষের স্বাতন্ত্র্যে হাত পড়বে। নেশন যেমন তার লোভের চাহিদা পূর্ণ করার জন্য অপর মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তেমনই সমাজবাদের দোহাই দিয়ে জোর করে ব্যক্তিসম্পদের অধিকারের বিলোপ ঘটালে মানুষের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হয়। নেশনের ছাঁচ অপছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ, অপছন্দ করতেন সমাজবাদের ছাঁচকেও। জোর করে ধনীর সম্পদ হরণ করে সবাইকে সমান করার যান্ত্রিক পদ্ধতি মানুষের মনে যে কী ক্ষোভ তৈরি করে, তা গত শতকে পূর্ব-ইউরোপের বামপন্থী দেশগুলি ভেঙে পড়ার সময় টের পাওয়া গিয়েছিল।

কেউ বলতেই পারেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী বামদলগুলি আর ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপসাধনের প্রশ্নটিকে জরুরি বলে মনে করে না। ঠিকই। কিন্তু তা হলেও যে রবীন্দ্রনাথকে দখল করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ যে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ভীষণ গুরুত্ব দেন। এখনকার ক্যাডারনির্ভর বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী দলগুলি ব্যক্তিস্বরের বিভিন্নতাকে খুবই ভয় করে। দলীয় নিয়ন্ত্রণই সেখানে সব, কোথাও কোথাও দলীয় প্রধানই শেষ কথা। আর রবীন্দ্রনাথ? ‘রাশিয়ার চিঠি’তে খুবই প্রশংসা করেছিলেন সে দেশের, বলেছিলেন তাঁর তীর্থ দর্শনের অভিজ্ঞতা হল। তাই বলে জানাতে ভোলেননি, ‘‘গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। …ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না … একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।’’

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ সব দিক দিয়েই দলচরদের পক্ষে বিপজ্জনক, এবং নাগরিক সমাজের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মানেন তিনি, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যান না। গাঁধী রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নানা সময়ে যে বিতর্ক হয়েছে, তার মূল বিষয় এই ব্যক্তিস্বাধীনতা। গাঁধী যখনই চরকা কাটা, আশ্রম করে থাকা ইত্যাদি প্রসঙ্গে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হাত দেন, রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করেন। চরকা কাটা গাঁধীর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, গাঁধীবাদীরা না বুঝে নিজেদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ভুলে যদি চরকা কাটেন, তা হলে সেই যান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের ঘোরতর আপত্তি।

স্বাধীন ব্যক্তি তো সমাজেরই অংশ। সমাজের অংশ করে তোলার জন্য দল বেঁধে ব্যক্তির ওপর জোর খাটানোর দরকার নেই। ব্যক্তি নিজেই উপলব্ধি করবেন তাঁর সামাজিক দায়িত্বের কথা। আসলে রবীন্দ্রনাথ জীবনযাত্রার বিশেষ এক মানদণ্ড ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সেই মানদণ্ডটি অনুশীলনসাপেক্ষ। কেউ তা শিখিয়ে-পড়িয়ে চাপিয়ে দিতে পারে না। নিজের ভেতর থেকে তা বোঝা চাই।

গণতন্ত্রের উৎসব মানে তো দলচর হয়ে ভোট দেওয়া নয়। গণতন্ত্রের উৎসব মানে নাগরিক সমাজের নিজস্বতার প্রকাশ। রাজনৈতিক দলগুলি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়। নাগরিক সমাজ অপ্রস্তুত ও অনুশীলনহীন হলেই দলেরা মাথায় চেপে বসে। তখন তৈরি হয় ত্রাসের রাজত্ব। সেই রাজত্ব অতিক্রম করে সবাই রাজা হতে গেলে নিজেকে প্রস্তুত করা চাই, সেই প্রস্তুতিরই এক রকম দিশা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের লেখায়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here