এ.এম জিয়া হাবীব আহসান :
গণসংগীত, দেশাত্মবোধক গান, পুরনো দিনের গান, গজল, না’ত রাসূল (সাঃ), আবৃত্তি প্রভৃতির প্রতি আমার আকর্ষণ একেবারে ছোটবেলা থেকেই। কাজের ফাঁকে তাই খুঁজে নিই ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেব, তালাত মাহমুদ, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে, মেহেদী হাসান, গোলাম আলী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফিসহ নানা প্রিয় শিল্পীর গান ও গজল। ছোটবেলা গ্রামে-গঞ্জেও কবিয়াল, শহীদী  মারফতী, ভাওয়াইয়া, মরমী গানের জমজমাট আসর বসতো। এসব এখন শুধু স্মৃতি, চট্টগ্রামসহ দেশের আনাচে-কানাচে কাওয়ালী অনুষ্ঠান মানুষকে বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক আনন্দ দিত। এখনও চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অভিজাত শ্রেণীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে কাওয়ালী একটি বিশুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম মাধ্যম। মাতৃভাষার পাশাপাশি উর্দু, হিন্দি, ফার্সি, আরবি প্রভৃতি ভাষায় কাওয়ালী, গান-গজল প্রভৃতি রচনা-সুর দেয়া ও দর্শক শ্রোতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাতিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বে¡ও এসব বিদেশী ভাষায় সংগীত চর্চায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিলেন এই চট্টগ্রামেরই ফটিকছড়ির নানুপুর সৈয়দ বাড়ীর সন্তান, তদানীন্তন পাক-ভারত উপমহাদেশের বরেণ্য কাওয়াল মরহুম আবু আহমদ। যিনি “আবু কাওয়াল” নামেই খ্যাতিমান ও সর্বসাধারণে আজো সুপরিচিত। দেশী-বিদেশী ভাষায় সংগীতে এমন ব্যুৎপত্তি ও জনপ্রিয়তা খুব কম শিল্পীর ভাগ্যেই জোটে। সম্প্রতি মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) বোয়ালখালী শাখার সহ সভাপতি ভাতৃপ্রতীম আল্লামা কাজী মোঃ যোবায়ের এর মাধ্যমে পরিচয় সূত্রে পরবর্তীতে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জনে পরিণত হন প্রখ্যাত শিল্পী মরহুম আবু কাওয়ালের সুযোগ্য সন্তান ও সফল শীর্ষ সংগীত শিল্পী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম প্রকাশ ইসলাম কাওয়াল এর সাথে। আমার ফুফা হাজী শমশের আলম চৌধুরীর কাছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কষ্টের কিছু গানের গজলের রেকর্ড শুনে মনের অজান্তে তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। টেলিফোনে তিনি আমার অনুরোধে আমাকে বেশকিছু গান- গজলও শুনিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সামনা সামনি দেখার প্রচ- আকুতি আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। নিরহংকারী সহজ সরল বড় শুভ্র মনের এ মানুষটিকে কেউ না দেখলে, তাঁর গান কথা না শুনলে কেউ বুঝতে পারবেন না কী সম্পদ আমাদের অজান্তে অনাদরে, অবহেলায় পড়ে আছে। তিনি আমাকে ও বন্ধুবর এডভোকেট মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিনকে তার বাসায় দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন। অবশেষে গত ১০ ডিসেম্বর সুযোগ হয়েছিল। তিনি আমাদের হঠাৎ কাছে পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করে ফেললেন বিশ্বমানবতার মুক্তি সংগীত মানবাধিকার সংগীত। তাঁর চান্দগাঁও বি-ব্লক এর ৯ নং রোডের ২১৬ নং বাসার তৃতীয় তলায় আমরা নির্দিষ্ট সময় পৌঁছে গেলাম। সাথে মানবাধিকার কর্মী কাজী যোবায়ের এবং আব্দুল রাজ্জাকসহ অন্যান্যরাও উপস্থিত। প্রসস্ত ড্রইং রুমে কুশলবিনিময় শেষে মাটিতে (কার্পেট বিছানো) বসেই শুরু হলো সংগীতের মাধ্যমে অতিথি আপ্যায়ন বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে রচিত সংগীত-

“হে বিশ্ববাসী হে মানব জাতি….”
অসাধারণ সুর ও কথায় শিল্পীর স্বরচিত গানটি নিজ কণ্ঠে গেয়ে শুনালেন বরেণ্য শিল্পী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। আত্মার আপ্যায়ন সংগীতের পাশাপাশি ঝাল মুড়ি, চানাচুর, সরিষার তেলে ধনে পাতা, পিয়াজ মেশানো সিংগারা, ডালপুরি, চা আসা শুরু হলো। বুঝলাম এটা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের অনুরোধে তিনি একের পর এক তাঁর নিজের, তাঁর পিতার রচিত হাম্দ, না’ত, গজল পুরানো দিনের গান শুনাচ্ছেন আর তন্ময় হয়ে আমরা চেয়ে আছি এ অসাধারণ সংগীত প্রতিভার কণ্ঠ সুধা ও বাচনভঙ্গিতে। উর্দু, হিন্দি, আরবি, ফার্সি ইংরেজি ভাষার উপর তাঁর এমন দখল যা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। জিজ্ঞেস করলাম কে আপনার ওস্তাদ? কিভাবে এ জগতে আসলেন? তিনি বললেন, “উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী মরহুম সৈয়দ আবু আহমদ (আবু কাওয়াল), যিনি আমার পিতা, আমার ওস্তাদ, যার গান শুনে শুনে আমি সংগীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ি।
নানুপুরের এমন ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত সূফী-সাধক পরিবারে শিল্পী ইসলাম কাওয়ালের জন্ম। মাতা মরহুমা সৈয়দা আনজুমান আরা বেগম। তিনি ফটিকছড়ি ধর্মপুর সৈয়দ বাড়ীর মরহুম হযরত সৈয়দ আবদুল জলিল (রহঃ) এর একমাত্র কন্যা। মা-বাবা উভয় দিক থেকেই আধ্যাত্মিক চেতনা ও সাধনার উত্তরাধিকারী তিনি।  উর্দু, হিন্দি, বাংলায় রচিত ও সুরারোপিত গানগুলো তাঁর ডায়েরী উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলাম। হাতের লেখা যেন সুন্দর ছাপানো। যা রচনার তারিখসহ উল্লেখ আছে। তাঁকে বললাম আপনার রচিত সংগীতগুলোর সংকলন করছেন না কেন? তিনি বললেন “কে করবেন, এমন উদ্যোগ কে নিবেন?” ভাবলাম যে দেশে এমন গুণী শিল্পীর কদর নেই, সে দেশে আর কি এমন গুণী শিল্পী জন্মাবে। তবে জেনে খুশি হলাম বাজারে তাঁর গাওয়া গানের ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি, অডিও ভিডিও’র, অভাব নেই। প্রায় ৭৫টির মতো অডিও ও ভিসিডি বাজারে পাওয়া যায়। দেশে বিদেশে সর্বত্র সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্পীর খুব ইচ্ছা তাঁর রচিত ও সুরারোপিত মানবাধিকার সংগীতটি ইংরেজী ভার্সনসহ ইলেক্ট্রিনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া যা- ‘আমরা করবো জয় (We  shell over come)-এর মতো ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য, সাম্যের জন্য তাঁর আহ্বানের এ সুর ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। আমাদের সংগীত শুনা ও নানা প্রশ্নের উত্তর ও কথোপকথনের এক পর্যায়ে দুপুরের খাবার আসা শুরু হলো। এমন মেহমানদারীর দৃশ্য বর্তমান সময়ে খুবই কম দেখা যায়। কোন মতেই শিল্পীকে নিবৃত্ত করা গেল না। খেয়ে আসতেই হবে। চাক-চাক বেগুন ভাজা দেখে আমার মরহুম মায়ের রান্নার কথা মনে পড়ে গেল। সাথে শুঁটকীর বিশেষ তরকারী, দেশী মুরগির ঝোল রান্না, শাক-সবজী সাথে পোলাও আরো কত কি? শিল্পীর স্ত্রীও মেহমানদারীর ঐতিহ্য দেখেছেন তার পরিবার থেকে। তার স্ত্রী মিসেস শাফিয়া ইসলাম হলেন- আলহাজ্ব হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রহঃ) প্রকাশ চুনতির শাহ সাহেব কেবলার বড় নাতনী। ব্যক্তিগত জীবনে তারা ২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। জোহর নামাজ সেরে আমরা আবার কয়টি হাম্দ-না’তের আবদার করলে তিনি হাসি মুখেই আবদার রাখলেন। তাঁর কণ্ঠে পেয়ারা নবী’র (সাঃ) শানে না’ত শুনছিলাম আর চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আমাদের সংগীত চর্চায় সোনালী ঐতিহ্য আধুনিকতার নামে কিভাবে বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে তা ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। তাঁর কণ্ঠে কয়েকটি হারানো দিনের গান, মোঃ রফি,  মেহেদী হাসানের গানও শুনলাম। শিল্পী বললেন, ‘সংগীতের কোন ভাষা নেই। যে কোন ভাষাতেই গান গাওয়া যায়, তবে আমি যে গানটা গাইবো তাঁর অর্থ ও শুদ্ধ উচ্চারণটা জেনে নেয়া প্রয়োজন। তাই নতুন প্রজন্মের যারা বিদেশী ভাষায় গান করবেন তাদের জন্য এ বরেণ্য শিল্পীর পরামর্শ হলো আপনারা অর্থ এবং শুদ্ধ উচ্চারণে গান করার চেষ্টা করবেন। আর যারা অভিজ্ঞ তাদের কাছে গিয়ে ভালোভাবে শিখে তারপর গান পরিবেশন করাই ভালো।
তিনি বলেন, কাওয়ালী ও গজল গাইতে হলে আরবি, ফার্সি, উর্দু এবং হিন্দি ভাষা জানতে হয়। কিন্তু এসব ভাষা শেখার লোকের অভাব, তাই নিকট ভবিষ্যতে কাওয়ালী বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, কাওয়ালী, জারি, সারি ও আঞ্চলিক গান আমাদের ঐতিহ্য। এগুলোর চর্চা অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে আমাদের বাঁচাবে। আমাদের দেশের শিল্পী ও এর পৃষ্ঠপোষক যাঁরা আছেন তাদের এজন্যে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবেও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।
ইসলাম কাওয়াল এর শীষ্যদের মধ্যে মোঃ হাবিবুর রহমান কাওয়াল ও হান্নান হোসাইনীর নাম অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। শিল্পী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এশিয়ার এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশনে গিয়েছেন। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি বেতার ও টেলিভিশনে গান পরিবেশন করে আসছেন। তিনি কিভাবে সময় কাটান জানতে চাইলে বলেন, বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করে এবং বিভিন্ন ভাষায় গান, গজল, কবিতা লিখে ও সুর করে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। ইসলামে সংগীত চর্চার অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন শিল্পী মানুষকে সংগীতের মাধ্যমে সত্যের পথে, মানবতার পথে আহ্বান জানাতে পারেন। হাম্দ, নাত ও গজল এর মাধ্যমেও আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনায় উৎকর্ষতা সাধন করা যায়। দেশপ্রেমেও উদ্বুদ্ধ করা যায়। অনৈতিক, অবৈধ, অশ্লীলতামুক্ত সংগীত চর্চা কখনো ইসলামের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। বিশ্বনবী (সাঃ) আল্লাহ্র নির্দেশে মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে যখন মদিনায় হিজরত করলেন তখন মদীনাবাসী তাঁকে দফ বাজিয়ে গান গেয়ে সংবর্ধিত করেন এভাবে-
“তালা আল বদরু আলাইনা মিন সানিয়াতিল বিদায়ী,
ওয়াজাবাশ্ শুক্রু আলাইনা মা দা’আ লিল্লাহী দায়ী,
হযরত দাউদ (আঃ) আসমানী কিতাব যবুর তিলাওয়াতের সময় পাহাড় ভূমি তাল দিয়ে প্রকম্পিত হতো এবং পশুপাখি ও সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তা শুনার জন্য এসে পড়তেন। পবিত্র কুরআনুল করিমও সুর, স্বর, তাল, মাত্রা, কম্পন, ছন্দ, সুরেলা ধ্বনি এবং আল্লাহ্র  কুদরতি শক্তি আছে। যার তিলাওয়াত শুনে হযরত ওমরের (রাঃ) এর মতো সিংহ পুরুষের দিল গলে গেল মোমের মতো। সুললিত কণ্ঠে সংগীতের মতো ওয়াজ মাহফিলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হেদায়েত করেন নন্দিত ওয়াজিনেরা। সংগীত এর ভাবধারা যদি নিষ্কলুষ নির্দোষ হয় তা ইসলাম বিরোধী নয়। সুরের মাতলামী, অঙ্গভঙ্গিতে বাদরামী, উগ্র এবং কুরুচিশীলতা সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। সাধারণ জনগণ এবং সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র সমাজে মার্জিত কণ্ঠে সংগীত চর্চা মুসলিম সোনালী যুগে প্রচলিত ছিল। বর্তমান সময়েও গজল কাওয়ালী ও শুদ্ধ সংগীত সুধী মহলে সমাদৃত। সংশ্লিষ্ট সকলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি মুক্ত শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বলয় পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। মন্ত্র মুগ্ধের মতো এ বরেণ্য শিল্পীর সান্নিধ্যে ৩/৪ ঘণ্টা সময় অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে কেটে গেল। এমন সুমধুর কণ্ঠ ও প্রতিভাধর শিল্পীর যেন অযত্নে অবহেলায় অভিমানে অবেলায় হারিয়ে না যায় এটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। মহান স্রষ্টার কাছে শিল্পীর দীঘায়ু, সুখ, সমৃদ্ধি কামনা করে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম।

সাক্ষাৎকারটি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১১ মার্চ ২০১৫বুধবার প্রকাশিত |

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here