আলোকিত ডেক্স
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন মারা গেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকার গুলশানের শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে বন্দরনগরীতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
শুক্রবার (৬ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে সানজিদা শারমিন গাজী।
সানজিদা জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ৩১ জুলাই সালেহ উদ্দিনকে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ক্রমাগত অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে থাকায় অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ৩ আগস্ট থেকে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন গাজী সালেহ উদ্দিনের ৭৩ বছর বয়স হয়েছিল। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিন প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। খেলাঘর আন্দোলন, বধ্যভূমি রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে তিনি একজন সামনের কাতারের সংগঠক ছিলেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সেই বিচারের ক্ষেত্রে তার লেখা বইয়ের তথ্যকে দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখল করে রাখা বধ্যভূমি দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের আবেদন জানিয়ে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। সেই রিটের প্রেক্ষিতে আদালত সারাদেশে বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত অধ্যাপক আবু ইউসুফের সঙ্গে তাকেও পতেঙ্গায় র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে অপদস্থ করার অভিযোগ আছে।
তিনি খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি ছিলেন। সর্বশেষ চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকায় চট্টগ্রামে একটি ‘নৈতিক স্কুল’ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেখানে পড়াশোনা করছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা।
গাজী সালেহ উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বদরপুর গ্রাম। শহীদ পরিবারের সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহ উদ্দিন বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লেনে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদ আলী করিম এবং মাতা হুরমোজা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান।
গাজী সালেহ উদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের একজন অকুতোভয় সৈনিককে আমরা হারালাম। এই শূন্যতা কখনোই পূরণ হবার নয়। আমি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।’
সন্দীপনা কেন্দ্রী সংসদ বাংলদেশ, সন্দীপনা সাংস্কৃতিক সংসদ, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী চট্টগ্রাম, ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়ন (ইকো) সহ বিভিন্ন সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে।
গাজী সালেহ উদ্দিনের মৃত্যুতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষ থেকে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি নুরুল আলম মন্টু, সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী, মহানগর কমিটির সভাপতি ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক বি কে বিশ্বাস ও নারী বিষয়ক সম্পাদক সাইফুন নাহার খুশী।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘গাজী সালেহ উদ্দিনের মৃত্যুতে দেশ একজন মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বাধীনতার পক্ষের প্রগতিশীল আলোকিত মানুষকে হারালো। স্রোতের বিপরীতে তিনি নীতি আদর্শে আমৃত্যু অবিচল ছিলেন।’
চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গাজী সালেহ উদ্দিনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এ্যানি সেন ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী। শোকাবার্তায় তারা বলেন, ‘দেশ একজন অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে হারাল।’
ইকো’র সভাপতি সরওয়ার আলম মণি এবং সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল শোক বিবৃতিতে বলেন, ‘গাজী সালেহ উদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে তিনি অবিচল ছিলেন। তিনি একজন শহীদ পরিবারের সন্তানও ছিলেন। আলোকিত বোয়ালখালী পরিবার তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।’