রনজিত কুমার শীল
শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস–
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় ঃ
“অপুত্রক পুত্র পায় কালাচাঁদ বরে,
নির্ধনের ধন দাতা অশেষ প্রকারে
অন্ধজনে পায় চক্ষু সুখহীনে সুখ,
অনাথেরে করে দয়া না করে বিমুখ”।
শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুর শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি। এটি একটি বড় জাগ্রত দেবতা। “অপুত্রক” কে পুত্র দান করিতে এমন মুক্তহস্তদেবতা বোধহয় বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে দ্বিতীয় আর নাই। পশ্চিমবঙ্গের তারকেশ্বরে যেমন ধর্না)দিয়ে যেমন দুরারোগ্য ব্যাধির ঔষধ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি কালাচাঁদ ঠাকুরের কাছে ধর্না দিয়ে তেমনই অপুত্রক পুত্র লাভ করে। প্রতি অন্নপ্রাশনের তিথিতে ঠাকুরের মন্দিরে হাজার হাজার পুত্রবতী জননীর সমাগম হয়। মায়ের কোলে দেবতার দান গোপালমূর্তি (কৃষ্ণমূর্তি) দেখতে যাঁদের স্বাদ, তাঁরা মন্দিরে আসলে বড় আনন্দ পাবে। এখানে ধর্না দিয়ে যাঁহারা পুত্র লাভ করেন, তাঁরা পুত্রের অন্নপ্রশন দিতে এখানেই আসেন; তাঁদের প্রতি না কি সেরূপ আদেশও আছে। শুধু পুত্রলাভ নয়, মন্দিরে ধর্না দিয়া দৃষ্টিহীনও দৃষ্টি ফিরে পেয়ে দিব্বি হেঁটে অনেকে নিজ গন্তব্যে চলে যান। এছাড়া বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি ও মামলা মোকদ্দমা থেকে অব্যাহতিসহ যে কোন সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য এখানে ধর্না দিয়ে থাকে। কে কিভাবে মুক্তি পেয়েছেন তাঁরাই ভাল জানেন। এখানে প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে ৪ দিন ব্যাপী ষোড়শপ্রহর মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঠাকুর মন্দির ও আশপাশের সার্বিক পরিস্থিতি নজরে রাখতে কালাচাঁদ ঠাকুরবাড়িকে সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। এখানে মন্দির পরিচালনার জন্য ২৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিঠি রয়েছে। কমিটির সকল কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিচক্ষনতায় কালাচাঁদ ঠাকুর মন্দিরের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমান কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যরা হচ্ছে-কিরণ কুমার ভঞ্জ (সভাপতি), রনজিত চৌধুরী বাচ্চু (সহ-সভাপতি), বরুণ ভট্টাচার্য্য (সহ-সভাপতি), আশুরঞ্জন চৌধুরী (সহ-সভাপতি), প্রদীপ মল্লিক (সহ-সভাপতি), সঞ্জয় দে (সহ-সভাপতি), রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক), শ্যামল মজুমদার (যুগ্ম সম্পাদক), সমীরণ দেব (সহ-সম্পাদক), জ্যোর্তিময় চৌধুরী (দপ্তর সম্পাদক), রনজিত কুমার শীল (প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক), বিটু মিত্র (মেলা বিষয়ক সম্পাদক), তুষার নন্দী ফুলু (সাংস্কৃতিক সম্পাদক), কার্যনির্বাহী সদস্য যথাক্রমে-জগদীশ চৌধুরী, উময় শংকর আচার্য, চিত্তরঞ্জন শীল শিবু, লিটন ঘোষ, পংকজ চক্রবর্তী, বিমান দাশগুপ্ত, পলাশ গাঙ্গুলি, অশোক ধর, রাজীব পাল ও রাজীব চক্রবর্তী।
শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঃ প্রায় তিন শতবছর বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম জেলার অর্ন্তগত হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ এলাকার (বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর অন্তর্ভুক্ত কুলগাঁও) এর প্রান্তভাগে কালাচাঁদ নামে জনৈক বৈষ্ণব বাস করতেন। তাাঁর বাড়ীর সন্নিকটে একটি প্রকান্ড দীঘি ছিল। ভক্ত কালাচাঁদের প্রতি একদিন স্বপ্নে আদেশ হয়-“তুমি যদি দীঘির ধারে নিম্ববৃক্ষের নি¤েœ প্রত্যুষে গিয়ে কীর্ত্তন করিতে থাক, তাহা হইলে দেখিবে স্বয়ং লক্ষীনারায়ণ তোমার নিকট আসার জন্য ঐ দীঘির জলে ভাসিয়া উঠবে; তুমি তখন তাঁদের লইয়ো।” স্বপ্নাদেশ বিশ্বাস করিয়া কালাচাঁদ অতি প্রত্যুষে দিঘীর ধারে সেই নিম্ববৃক্ষের নীচে গিয়া কীর্তন আরম্ভ করিতেই দেখিতে পাইল, সত্য সত্যই দীঘির জলে দুই মূর্তি ভাসিয়া উঠিয়াছে। দীঘির চারিধারে পদ্মবন ছিল।
ভক্ত কালাচাঁদ সেই কন্টকবন অতিক্রম করিয়া মূর্তির নিকট গিয়া বামহস্তে লক্ষী ও ডানহস্তে নারায়ণের মূর্তি স্পর্শমাত্র সুবর্ণময়ী লক্ষীমূর্তি জলে ডুবিয়া অন্তর্হিত হল। অতঃপর বৈষ্ণব দুই হস্তে চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তি ধারণপূর্বক দীঘির পাড়ে আনিয়া নিম্ববৃক্ষের নি¤েœ
রাখলেন এবং মা আবার ভাসিয়া উঠবেন এই আশায় কীর্ত্তন করিতে লাগলেন। বহুক্ষণ কীর্তনের পরও যখন মায়ের মূর্তি ভাসিয়া উঠলেন না, তখন “মা মা” বলে ভক্ত বৈষ্ণব দীঘির জলে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলে, দৈববাণী হল-“তুমি বাম হস্তে প্রথম মাতৃমূর্তি স্পর্শ করলে বলে মা অন্তর্হিত হলেন । তুমি এখন আমাকে ঘরে নিয়ে যাও; বৃথা অনুশোচনা করিও না।” তখন বৈষ্ণব কালাচাঁদ নিজেকে বহু ধিক্কার দিয়ে প্রস্তর নির্মিত বিষ্ণুমূর্তি নিজগৃহে নিয়ে গেলেন। বৈষ্ণব কালাচাঁদ বিষ্ণুমূর্তি গৃহে এনে দিনের পর দিন কীর্তনানন্দে বাসুদেব নারায়ণের পূজা করতে লাগলেন। এমন সময় হাওলা (বর্তমান বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রাম) নিবাসী পরম ভক্ত দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ রামহরি আচার্য্য এর প্রতি স্বপ্নযোগে আদেশ হল “আমাকে তোমার নিকট এনে রাখ এবং ভক্ত কালাচাঁদ এর নামে নামকরণ কওে আমার পূজা কর।” ভক্ত কালাচাঁদের প্রতিও তদানুযায়ী স্বপ্নাদেশ হলে কালাচাঁদ স্বয়ং রামহরি আচার্য্যের গৃহে গিয়ো বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন পূর্বক সপ্তাহকালের মধ্যে বৈকুণ্ঠ লাভ করলেন ।
কথিত আছে কালাচাঁদ আর রামহরি আচার্য্য সম্পর্কে গুরুশিষ্য । কে গুরু আর কে শিষ্য তা এখনো অনুদঘটিত। অতঃপর তখন থেকে বিষ্ণুমূর্তি “শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুর” নামে অভিহিত হয়ে নিত্য পূজা পাচ্ছে ও মন্দিরটি “শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুরবাড়ী” নামে পরিচিতি পায়।
শ্রী শ্রী ঠাকুরের উত্তরমুখী হওয়ার কাহিনী ঃ মন্দিরের দক্ষিণে (পিছনে) যেখানে বর্তমানে শিবমন্দির ও দুর্গা মন্দির অবস্থিত রয়েছে। সেখানেই প্রথম শ্রী শ্রী ঠাকুরের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। তখন পাকা মন্দির ছিল না। ছিল না ঘেরা বেড়া। বাঁশের ভাঙ্গা ঘরে ঠাকুরের পূজা হতো। এখানেই ঘটে অলৌকিক ঘটনা। ব্রাহ্মণ, ঠাকুরের পূজা শেষ করে সন্ধ্যায় ঠাকুরকে শয্যা দিয়ে দরজা বন্ধ করে যথারীতি নিজগৃহে চলে যান। সকালে ব্রাহ্মণ এসে দরজা খুলে দেখেন দক্ষিণমুখী বিষ্ণুমূর্তি উত্তরমুখী হয়ে আছে। ব্রাহ্মণ মনে করেন কেউ হয়তো দুষ্টুমী করে এ-কাজ করেছে। আবার বিষ্ণুমূর্তিকে দক্ষিণমুখী করে পূজা সেরে সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি দিয়ে ভাল করে দরজা লাগিয়ে ব্রাহ্মণ নিজগৃহে চলে যান। পরদিন সকালে এসে দেখেন একই অবস্থা। ঠাকুর উত্তরমুখী হয়ে গেছে। আবার দক্ষিণমুখী করে ব্রাহ্মণ ঠাকুরের পূজা করলেন। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। ব্রাহ্মণ, ঠাকুরকে দক্ষিণমুখী করে আর ঠাকুর উত্তরমুখী হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে ঠাকুরকে উত্তরমুখী করে পূজা করে সন্ধ্যারতি দিয়ে দরজা বন্ধ করে ব্রাহ্মণ নিজগৃহে চলে যান। পরদিন
এসে ঠাকুরের কোন পরিবর্তন না দেখে পরম ভক্ত “রাম হরি” ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অনুভব করলেন বিষ্ণুমূর্তি শ্রী শ্রী বাসুদেব উত্তরমুখী হয়ে ঠাকুরের পরমভক্ত বৈষ্ণব কালাচাঁদের দিকে চেয়ে আছেন। যাঁর হাতে তিনি ধরা দিয়েছিলেন। অদ্যাবধি ঠাকুর উত্তরমুখী। উত্তরমুখী অবস্থায় শ্রী শ্রী কালাচাঁদ ঠাকুরের পূজা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্য কোথাও বিষ্ণুমূর্তি শ্রী শ্রী বাসুদেবের অবস্থান উত্তরমুখী অবস্থায় আছে কি না আমার জানা নেই। ###
লেখক – রনজিত কুমার শীল, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান-সংবাদ সংস্থা ‘এনএনবি’, সিনিয়র রিপোর্টার- দৈনিক খবর, সদস্য-চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বোয়ালখালী প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here