নিজস্ব প্রতিবেদক : দূর দূরান্ত থেকে ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বুড়া মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে হাজারো মুসল্লীর সমাগম ঘটেছে। ১৭ মে শুক্রবার ১১ রমজান জুমার নামাজে হাজারো মুসল্লী এক সাথে নামাজ আদায় করেছেন।
বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা আলহাজ¦ মো. ইলিয়াছ জানান, তিনি নগরীর পশ্চিম মাদার বাড়ী এলাকা থেকে এসেছেন। ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে ছোটবেলা থেকে নামাজ আদায় করতে আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানেও দেশের যে প্রান্তে থাকি না কেন, অধীর আগ্রহে জুমার নামাজ আদায় করতে ছুটে আসি।’
চট্টগ্রামের ইসলামী স্টিল মিলস্ লি. এর ব্যবস্থাপক মো. নাছির উদ্দিন সবুজ বলেন, পুর্ব পুরুষের কাছ থেকে এ মসজিদের গুরুত্ব সর্ম্পকে জেনেছি। এখানে নামাজ আদায় করে প্রশান্তি লাভ হয়। তাই সুযোগ পেলে এ মসজিদে ছুটে এসে একান্তে সময় কাটান বলেন জানান তিনি।
শ্রীপুর বুড়া মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতার ওয়ারিশ মো.নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, এ মসজিদে নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে পরম করুণাময় আল্লাহ’র দিদার লাভের আশায় হাজারো মুসল্লী সমাগম ঘটে জুমা’র দিন।
তিনি জানান, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এ মসজিদে আসেন নানান ফজিলত, মানত, নিয়ত ও মনোবাসনা পূরণের আশায়। আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালিয়ে মনের দু:খ দুর্দশার কথা জানিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটান তারা।
বাঁশখালী থেকে সীমা দেবী নামের এক মহিলা বিপদ-আপদ ও রোগ মুক্তির আশায় তার মাকে নিয়ে এসেছেন মসজিদে । সাথে এনেছেন এনেছেন সিন্নি । স্থানীয় শিল্পি দে নামের এক মহিলা সাত বছর বয়সি ভাইজির জ্বর না কমায় মানত করেছেন মসজিদের পুকুরে স্নান করার । তেমনি আরো বহু মানুষ এসেছেন মানত নিয়ে।
নগরীর অক্সিজেন থেকে আসা সৈয়দ ওসমান গনি জানান, হালি শহর বড় পুল এলাকার এক রোগী সুস্থ হওয়ার জন্য সাত জুমা নামাজ আদায় করার নিয়ত নিয়ে বুড়া মসজিদে এসেছিলেন । অসুস্থ হওয়ায় তিনি চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করতেন। তিন জুমার পর দেখি তিনি সুস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন।
বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী বুড়া মসজিদ প্রায় ৩শ বছর পূর্বে শনের ছাউনি দিয়ে তৈরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষের কাছে তীর্থভুমি হিসেবে সমাদৃত এ মসজিদ।
এখানে দেশ বিদেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমাগম ঘটে বরকত, ফজিলত ও পুর্ণ্যরে আশায়। এখন থেকে ৩০০ বছর পূর্বে মোঘল আমলের শেষ দিকে এটি নির্মিত হয় বলে অনেকেরই ধারণা। এ মসজিদ কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সঠিক সন তারিখ কারো জানা নাই।
চট্টগ্রামের তৎকালিন প্রশাসক থানাদার ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাঁর দাদা শেখ নাছির উদ্দিন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের গৌড় এলাকা থেকে এ এলাকায় দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। খুব সম্ভবত শেখ নাছির উদ্দিন ধর্ম প্রচার করে দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাঁর অধস্তন পুরুষ থানাদার দীক্ষিত লোকদের পাঞ্জাগানা নামায আদায়ের সুবিধার্থে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
এ মসজিদের নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, ওয়াসিন চৌধুরীর পিতা ইবাদত বন্দেগীতে এতই মশগুল থাকতেন যে, পারিপাশ্বিক অবস্থার কোন খবর রাখতেন না। তিনি বুড়ো বয়সে ঐ মসজিদে নামাজ যিকির আজকারে দিন রাত কাটিয়ে দিতেন। এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যেত তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনায়। তিনি এতই পরহেজগার ছিলেন যে, তাকে সবাই বুড়া হুজুর নামে ডাকত। ইবাদত করতে করতে তিনি একদিন এই মসজিদ থেকে হারিয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর কোন সন্ধান কেউ পাননি বলে কথিত আছে। তাই তাঁর নামানুসারে এটি ‘বুড়া মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন।
অল্প কজন মুসল্লী নামাজ পড়ার মত জায়গা নিয়ে শন পাতার বেড়া এবং উপরে দু’নালি শন দিয়ে মসজিদের প্রথম ঘর নির্মিত হয়। প্রতি বছর ছাউনি ও বেড়া পরিবর্তন করে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত কাটিয়েছে এ মসজিদের কার্যক্রম। ঝোঁপ-ঝাড়ের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এ মসজিদে মুসল্লীরা রাতে নামাজ আদায় করতে পারতেন না। নিরাপদ দুরত্বে থেকে মুসল্লীরা আজান দিয়ে চলে যেত।
পরবর্তিতে চারপাশে বাঁশের বেড়া এবং উপরে শনের ছাউনি দিয়ে ১০-১৫ হাত লম্বা ও চওড়া করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বহু বছর যাবৎ এ ভিত্তি চলে আসতে থাকে। খুব সম্ভবত ১৮৮৬ সালের পরে স্থানীয় লোকজন মাটির দেয়াল তুলে পুন;নির্মাণ করেন এ মসজিদটি। এভাবে ৪-৫ বার নির্মাণ করা হয়। এখন থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে মসজিদের কিয়দংশ পাকা করা হয়।
১৯৪০ সালে মসজিদের পুরাতন ভিত্তি ভেঙে নতুন করে ছাদ জমিয়ে পাকাকরণ করা হয়। এই ইমারত এখনও পর্যন্ত মসজিদের মধ্যখানে বহমান আছে। ১৯৭৪ সালে ৫-৬ শ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা করে মসজিদ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে ২য় তলায় উন্নীত করা হয় এ মসজিদ। ১৯৭৫ সালের দিকে এ মসজিদের পাকা ভবনের প্রবেশদ্বার নির্মিত হয়।
এ মসজিদের পাশে অবস্থিত বিশাল কবর স্থান মসজিদের মৌলিক আকর্ষণ। মসজিদ সংলগ্ন এ কবরস্থানে বহু আলেম ওলামা বুজর্গদের সমাহিত করা হয় বলে জানা যায়। ৭ তলা বিশিষ্ট মিনার মসজিদের যেমন শোভাবর্ধন করেছেন তেমনি আকাশছোয়া অবস্থানের কারণে দুর থেকে বুড়া মসজিদের স্মৃতি চিহ্ন জানান দেয়। সম্মুখে মনোহরি পুকুর কুঞ্জে বেষ্টিত।
দেখা গেছে, প্রতি জুমাবার বহু দুর-দুরান্ত থেকে অসংখ্য মুসলীø জুমার নামাজ আদায় করতে ছুটে আসে এ মসজিদে। বিভিন্ন নিয়ত করে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষ এখানে এসে ফয়েজ বরকত হাছিল করেন। অনেকেই হাঁস মুরগি, গরু, ছাগল, অনেকে সিন্নি রান্না করা খাবারও পাঠান এ মসজিদে। এসব সিন্নি, রান্নাকরা খাবার মুসল্লী ও ফকির মিসকীন মাঝে বিতরণ করা হয়।
এ মসজিদে বিভিন্ন সময় যারা মোতওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আব্দুল গণি চৌধুরী, হাফেজুর রহমান চৌধুরী, মুকলেছুর রহমান চৌধুরী, মুহাম্মদ এখলাছুর রহমান চৌধুরী, মুহাম্মদ মিয়া চৌধুরী, ব্যাংকার মুহম্মদ কামালউদ্দীন। বর্তমানে অফিসিয়াল মোতোয়াল্লী হিসেবে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
এ ছাড়া মসজিদের সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন, মো. মোজাহেরুল হক চৌধুরী, মো. হামিদুল হক চৌধুরী, মো. ইদ্রিস মিয়া, আবদুল মান্নান চৌধুরী, মো.আলী চৌধুরী, মো.তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, ননা মিয়া চৌধুরী, সামশু মিয়া চৌধুরী।
খতিব হিসেবে ছিলেন শতায়ু আলিম ওস্তাজুল ওলামা মাওলানা মুহম্মদ মুফতি ইদ্রিছ রেজভী (ম:)। তিনি চরণদ্বীপ ইসলামিয়া রজভিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য সন্তান অধ্যক্ষ মাওলানা শোয়াইব রেজা খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
পেশ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, মাওলানা জিয়া উদ্দীন, মাওলানা ওসমান গণি, আব্দুর রহমান আল কাদেরী, বর্তমানে অস্থায়ী সহকারি পেশ ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা মো. সোহেল আজাদ আর মুয়াজ্জিন ছিলেন, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা গুল বক্স, বর্তমানে মাওলানা মো. ইয়াকুব আলী মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন।
এবি/ডিবি/সবুজ/পিএস।