
শিশুর জীবন সুরক্ষার জন্য টিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে। (ফাইল ছবি)
প্রণব কুমার চৌধুরী
টিকাদান সম্পর্কিত তথ্য
সময়সূচি অনুযায়ী সব কটি টিকা নিলে শিশু মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলো থেকে রক্ষা পাবে। সময়সূচি অনুযায়ী টিকা না নিলে, শিশুর দেহে মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি না–ও হতে পারে।
সর্দি-কাশির মতো ছোটখাটো অসুস্থতার মধ্যেও টিকা দেওয়া যায়। টিকা প্রদান–পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত খুবই সামান্য হয়।
বিসিজি টিকার নির্দিষ্ট ডোজটি জন্মের পরপরই দেওয়া যায়। বিসিজি টিকা দেওয়ার এক থেকে দেড় মাস পর টিকার স্থানে (বাঁ বাহুতে) স্বাভাবিকভাবে ঘা হবে, এটি এমনিতেই সেরে যায়।
ডিপিটি টিকা দেওয়ার পর সামান্য জ্বর ও টিকার স্থানে অল্প ব্যথা হতে পারে এবং সাময়িকভাবে টিকা দেওয়ার স্থান শক্ত হয়ে যেতে পারে, এতে ভয়ের কিছু নেই।
হাম/এমএমআর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ টিকা প্রদানের ১০–১২ দিন পরও সামান্য জ্বর ও গায়ে দানা দেখা দিতে পারে। এটা এমনিতেই সেরে যাবে। জ্বরের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্যারাসিটামল খাওয়ানো যায়।
অসুস্থ শিশুকে সাময়িকভাবে টিকা দেওয়া যাবে না। তবে শিশু সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা দিতে হবে এবং সময়সূচি অনুযায়ী শেষ করতে হবে। আগের টিকা নেওয়ার পর কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকলে ডাক্তারকে তা জানানো উচিত। ডাক্তার নির্দেশিত সময়সূচি অবস্থাভেদে পরিবর্তন করতে পারেন।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শিশুকে টিকাদান
অকালে জন্ম নেওয়া (প্রি-টার্ম) নবজাতক
বেশির ভাগ অকালজাত (গর্ভকাল ৩৭ সপ্তাহের কম) ও স্বল্প জন্ম-ওজনের (জন্ম ওজন ২৫০০ গ্রামের কম) নবজাতক শিশুকে পূর্ণ গর্ভকাল (টার্ম) পাওয়া ও স্বাভাবিক জন্ম-ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো সময়সূচি অনুযায়ী ইপিআই টিকাদান শুরু করা উচিত। অনেকে মনে করেন, যেহেতু শিশু সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছে বা তার জন্ম–ওজন কম, সেহেতু তাকে খানিকটা দেরি করে টিকাদান করানো প্রয়োজন। এসব শিশুকেও ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপর নিয়মমাফিক সময়মতো ও নিয়মিত টিকাদান করানো যায়। টিকার ডোজ ও মাত্রা একই নিয়মের থাকবে, তা কমানোর প্রয়োজন নেই।
সময়মতো টিকা গ্রহণ করা না হলে
বিভিন্ন কারণে অনেক শিশুর টিকাদান শিডিউলে একটা বা দুটো টিকা বাদ পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে টিকাদানের মধ্যবর্তী বিরতি দেরিতে হলেও যখনই সম্ভব পূর্বে গ্রহণ না করা টিকা সত্বর দিয়ে দেওয়া উচিত। একইভাবে দেরিতে গ্রহণ করা বুস্টার ডোজ টিকাও শিশুকে প্রদান করা হলে তা কার্যকর থাকে।
পূর্বে টিকাদানের কোনো প্রমাণ না থাকলে
যদি শিশুর পূর্বের টিকাদানের কোনো নথিপত্র পাওয়া না যায়, তাহলেও প্রয়োজন মনে করা হলে এসব শিশুকে পোলিও, হেপাটাইসিস-বি ভ্যাকসিন, এমএমআর, হিব বা জলবসন্তের টিকাদান করা যায়। শিশুর বয়স সাত বছরের নিচে থাকলে ডিপিটি এবং বয়স সাত বছরের বেশি হলে টিডি টিকা প্রদান করতে হবে। শিশু পূর্বে যদি এসব টিকা পেয়েও থাকে, তবে পুনর্বার দেওয়া হলে কোনোরূপ অসুবিধা হবে না।
কৈশোর-বয়ঃসন্ধিকালের টিকা
ইপিআই শিডিউলে থাকা সব কটি টিকা শিশু-বয়সে পেয়েছে। শৈশব পেরিয়ে এখন কৈশোর-বয়ঃসন্ধিকালে অবস্থান যাদের, তাদের রোগ প্রতিরোধক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু টিকাদান পরামর্শ আছে। কেননা—
ক. ইপিআই শিডিউলে থাকা হুপিং কাশির যে তিন ডোজ ভ্যাকসিন শিশু তার ৩ ডোজ ‘ডিপিটি’তে পেয়েছে, দেখা যায় পাঁচ থেকে আট বছরের মাথায় তার কার্যকারিতা অনেকাংশে লোপ পায়; যে কারণে অনেক যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ হুপিং কাশজনিত ক্রোনিক কাশিতে আক্রান্ত হন।
খ. একইভাবে এ বয়সে এসে শিশুর ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস ও জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণের বিধিমালা জারি হয়েছে। সুতরাং সচেতন অভিভাবকেরা তাঁদের কিশোর-বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানদের জন্য এসব ভ্যাকসিন প্রদান করতে পারেন, সেসব হলো—
টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, পারটুসিস (টিডিএপি)/টিডি: এক ডোজ ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে।
হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি): কন্যাসন্তানে, ০, ১ বা ২ কিংবা ৬ মাসের বিরতিতে তিন ডোজের টিকা। শুরু ১১ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তবে ৯ বছর বয়স পূর্ণ হলে এ ভ্যাকসিন প্রদান করা যায়।
এমএমআর ভ্যাকসিন: এক ডোজ যদি পূর্বে না দেওয়া হয়।
হেপাটাইসিস-বি ভ্যাকসিন: যদি না আগে দেওয়া হয়।
টাইফয়েড ভ্যাকসিন: প্রতি তিন বছরে এক ডোজ টিকা।
ভেরিসেলা ভ্যাকসিন: ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের বিরতিতে দুই ডোজের টিকা, যদি না পূর্বে দেওয়া হয়।
হেপাটাইসিস-এ ভ্যাকসিন: ০ থেকে ৬ মাসের বিরতিতে দুই ডোজের টিকা, যদি না পূর্বে দেওয়া হয়।
মেনিনগোকক্কাল এমসিভি: ১১-১২ বছর বয়সে, তবে ১১-১৮ বছরের সবাই এ টিকা নিতে পারে। ১৬ বছর বয়সে একটা বুস্টার ডোজ। ইনফ্লুয়েঞ্জা: প্রতিবছর।
অন্যান্য ক্ষেত্রে
যেসব শিশু স্টেরয়েড ওষুধ গ্রহণ করে, যেসব শিশু এই ওষুধ দুই সপ্তাহের বেশি দিন ধরে প্রতিদিন দুই মিলিগ্রাম প্রতি কেজি ওজন হিসেবে গ্রহণ করে, তাকে এ ওষুধ বন্ধের এক মাসের পর টিকাদান করানো উচিত।
এসব শিশুকে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে টিকাদান করতে হবে।
যেসব শিশু এইচআইভি অসুখের শিকার, তাদের টিকাদানও শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে।
যেসব শিশুর প্লীহা থ্যালাসেমিয়া বা অন্য কোনো কারণে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাদের এ অপারেশনের দুই সপ্তাহ পূর্বে এস নিউমোনিয়া, এন মেনিনজাইটিডিস, ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি প্রভৃতি রোগজীবাণুর প্রতিরোধকারী টিকা প্রদান করতে হবে।
কোনো শিশু যখন ক্যানসার চিকিৎসার কেমোথেরাপি গ্রহণ করে, তখন তাকে এই চিকিৎসা শেষ করার তিন মাস পরে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে টিকাদান করানোর প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান,
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।