গত ২ এপ্রিল থেকে অসুস্থতা অনুভব করছিলেন চট্টগ্রামের গারটেক্স গার্মেন্টসের জুনিয়র কমার্শিয়াল ম্যানেজার মনজুর হোসাইন (ছদ্মনাম)। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই তার সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। অসচেতনতার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরাও কাছে আসতেন। ৮ এপ্রিল করোনা শনাক্তের পর থেকে তিনি নগরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা আগেই হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া ১১ জনের মধ্যে পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকা এলাকায় আক্রান্ত চারজন ওই গার্মেন্টস কর্মকর্তার পরিবারের। স্ত্রী, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। শুধু সাড়ে তিন বছরের ছোট মেয়েটির ফলাফল নেগেটিভ এসেছে।

সেদিন রাতেই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই গার্মেন্টস কর্মকর্তা মুঠোফোনে আর্তনাদ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার ছোট্ট মেয়ে এখন কার কাছে থাকবে। সে একেবারে সুস্থ। পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসবে। মেয়েটাকে তো আত্মীয়-স্বজন কেউ রাখবে না। আর মেয়েটিও মা ছাড়া কারও কাছে থাকবে না। এই মেয়ের কিছু হলে আমার পরিবারের কেউ বাঁচবে না।’

এরপর রাত প্রায় দেড়টার দিকে ওই পরিবারের বাকি চার সদস্যকে জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। অনেক অনুরোধের পর শিশুটিকে তার এক মামার হেফাজতে রাখা হয় বলে জানান পাহাড়তলী থানার ওসি মাইনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শিশুটির অবস্থান জানাজানি হলে ওই এলাকার লোকজন হয়তো আপত্তি জানাতে পারে। শিশুটির ভালো থাকাটাই জরুরি। আমরা নিয়মিত খোঁজ রাখছি।’

পরিবারের করোনায় সংক্রমিত হওয়া নিয়ে ওই গার্মেন্টস কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ২ এপ্রিল অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ছেলেরা নিয়মিত আমার জ্বর পরীক্ষা করত। অসচেতনতার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরাও কাছে আসত। সাগরিকা পেট্রলপাম্পের পেছনের গলির ভাড়া দুই বেড রুমের ভবনটিতে চাইলেও অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিবারের সবাই আমার কাছ থেকেই করোনা সংক্রমিত হয়েছে।’

মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. শফিকুল জানান, জেলার রাজৈর উপজেলার কোদালিয়া বাজিতপুর এলাকায় ১২ এপ্রিল এক ব্যক্তির করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এবার তার তিন বছরের শিশুসন্তানও আক্রান্ত হয়েছে।

ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুটির বাবা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় মাদারীপুর স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আইইডিসিআরে ওই পরিবারের মা ও শিশু দুজনের নমুনা পাঠানো হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৬ এপ্রিল) তিন বছর বয়সী ওই শিশুর করোনা পজেটিভ আসে। তিন বছরের শিশুটি করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তার মায়ের করোনা আক্রান্তের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ তিনি সার্বক্ষণিক শিশুটির সংস্পর্শে আছেন।’

এর আগে গত রোববার (১২ এপ্রিল) সবাইকে চমকে দিয়ে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো মাত্র আট বছরের এক বাকপ্রতিবন্ধী শিশু করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়। করোনা পজেটিভ হওয়ার খবর পৌঁছাতেই শিশুটিকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। রাত আড়াইটায় ওই শিশুকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

শিশুটির করোনা আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, শিশুটির খোদ বাবাই ওমানফেরত। সম্প্রতি এক চাচাও ওমান থেকে ফিরেছেন। আরেক চাচা এলাকায় ফিরেছেন করোনার হটস্পট রাজধানী ঢাকা থেকে। সাতকানিয়ায় করোনা আক্রান্তের মৃত্যুর পর আক্রান্ত হয়েছেন তার ছেলে এবং ছেলের চার বন্ধু। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়া একমাত্র রোগী নগরের হালিশহর শাপলা আবাসিক এলাকার গৃহবধূ হলেন এর আগে করোনা শনাক্ত নারীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। যিনি তার ভাসুরের স্ত্রীর সঙ্গে হোম কোয়ারেন্টাইনেে ছিলেন।

সম্প্রতি পারিবারিক সংক্রমণের সবচেয়ে বড় উদাহরণটি তৈরি হয়েছে লক্ষ্মীপুরে। জেলার রামগঞ্জের এক পোশাক শ্রমিকের কাছ থেকে সেখানে এখন ১৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জনই তার পরিবারের সদস্য, বাকিরাও আত্মীয়-স্বজন।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বিষয়টাকে পারিবারিক সংক্রমণ বলব না, পাশাপাশি থাকার কারণে এমনটা ঘটছে। আসলে চট্টগ্রামে করোনা সামাজিক সংক্রমণ চলছে। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সিওর হওয়ার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের লোকজনকে বেশি পরীক্ষা করছি তাই, তারা শনাক্তও বেশি হচ্ছেন। আমরা যদি পরীক্ষার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারতাম তাহলে দেখতেন আরও অনেকে করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হতো।’

প্রশ্নবিদ্ধ হোম কোয়ারেন্টাইন

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রবেশ করেন। তাদের মধ্যে করোনাদুর্গত ছয়টি দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশে প্রবেশ করেছেন ৯৪ হাজার মানুষ। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৪০০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন দেয়া হয়। এছাড়া দেশে করোনার সামাজিক সংক্রমণ শুরুর পর আরও প্রায় দুই হাজার মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইন দেয়া হয়।

কিন্তু দেশে করোনা গতিপ্রকৃতি বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রবাসী দেশে ফিরে মানেননি হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়মকানুন। দেশের নারায়ণগঞ্জসহ সর্বত্রই করোনার প্রাথমিক বীজ তারাই বুনেছেন। পরে অনেককেই প্রাথমিক অসুস্থতার পর হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হলেও পরিবারে মধ্যে তারা মিশেছেন কোনো নিয়মের ধার না ধরেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ১৪ জনের মধ্যে আটজনই বিদেশফেরত, বাকিরা তাদের সংস্পর্শে আসার পর ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই হোম কোয়ারেন্টাইনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলছিলাম হোম কোয়ারেন্টাইন বাংলাদেশের জন্য একেবারেই অকার্যকর একটি পদ্ধতি। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের বিকল্প নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রথমে প্রবাসীদের পর সম্ভাব্য রোগীদের হোম কোয়ারেন্টাইনের নামে পরিবারগুলোকে অরক্ষিত করা হয়েছে। সবার ক্ষেত্রেই প্রথমে তার নিজ পরিবারকে সংক্রমিত করেছেন।’

তবে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করা সম্ভব। আর এই মুহূর্তে আমরা সংক্রমণের আপার স্টেজে আছি। এখন আর কাউকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে না। সন্দেহ হলেই আইসোলেশনে রাখা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here