মো. তাওহিদুল হাসান রাকিব:
ঢাকা কি ব্যাটারি চালিত রিকশাকে গ্রহণ করবে, নাকি ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল রিকশাকে ধরে রাখবে?
আমাদের প্রাচীন রিকশার ব্যাটারি চালিত রূপান্তর যেমন রঙিন, তেমনি বিতর্কিত।
তবে এই পরিবর্তন এখনো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, আমরা এর বিকট হর্ন এবং বেপরোয়া গতিকে পছন্দ করি না। রাত ১০টার পর কেউ কেউ হয়তো মজা করে এই গতিশীল ব্যাটারি চালিত রিকশায় চড়তে পছন্দ করে, তবে অধিকাংশেরই মত হলো — আমরা চাই না এমন যানবাহন আমাদের আবাসিক এলাকা বা প্রধান সড়কে চলাচল করুক।
ঢাকার রিকশার এক ধরণের “ক্যাচি” ও “আউটল্যান্ডিশ” আকর্ষণ আছে। রিকশা শিল্প এখন ঢাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
সত্তর-আশির দশকের ঢাকায় ফিরে তাকালে, যখন শহরটি ছিল শান্ত ও সবুজ, এবং মানুষ জানত না যানজটের অর্থ কী — তখন এই মানবচালিত বাহন ছিল মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসা।
ঢাকায় এমন কেউ নেই যে জীবনে রিকশায় চড়েনি — শুধু ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রিকশা কেবল একটি বাহন নয়, এটি ঢাকার প্রাণ। এর রঙিন শিল্প, ধীর গতি ও সরলতা শহরের আত্মার প্রতীক।
আমার রিকশা প্রেম শুরু হয়েছিল শৈশবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছুটির দিনের আনন্দ মানেই ছিল ঘণ্টা ধরে রিকশা ভাড়া করে ঘুরে বেড়ানো। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে, মায়ের কোলে ছোট ভাই — আমরা ঘুরতাম সবুজ ও প্রশান্ত ঢাকার হেয়ার রোড, বেইলি রোড, হাইকোর্ট এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল। মাঝে মাঝে টপখানার ইগলুতে আইসক্রিম খাওয়ার বিরতি।
মা-বাবা সন্ধ্যায় দাদির বাসায় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে রিকশায় যেতেন। তখনকার জীবন ছিল সরল আর আনন্দময়।
আমার স্কুল যাত্রা ছিল আমাদের পাড়ার আব্দুল ভাইয়ের রিকশায়। সেই থেকেই আমার রিকশার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়।
তিনি রিকশার সিটে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া পাতা এনে দিতেন, দুই চাকার উপর রিকশা চালিয়ে দেখাতেন নানা কসরত। তখন থেকেই আমার গতি ও রোমাঞ্চের প্রতি আকর্ষণ জন্মে।
কিন্তু আজকের এই “মোটরচালিত বিশৃঙ্খলা” একেবারে সহ্য হয় না। হঠাৎ গতি, তীব্র ব্রেক, কঠিন বাঁক — সবই অস্বস্তিকর।
বাংলা রিকশা থেকে ব্যাটারিতে
সাইকেল ঘণ্টার সেই চিরচেনা টিংটিং শব্দ, সংকীর্ণ ছাউনি — সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের “বাংলা রিকশা” এখন বিলুপ্তির পথে।
ব্যাটারি চালিত রিকশাচালক আব্দুল মজিদ বলেন, “আগে শত শত বাংলা রিকশা থাকলেও এখন কেবল হাতে গোনা কয়েকটা দেখা যায়। যাত্রীরা দ্রুত পৌঁছাতে চায়, তাই ব্যাটারিওয়ালাগুলোই চায়।”
গ্যারেজ মালিক সোহেল আনোয়ার জানান, “আগে যারা প্যাডেল চালাত, এখন সেই রিকশাগুলোকেই ব্যাটারি–মোটরে রূপান্তর করা হচ্ছে। চীনা মোটর, কন্ট্রোলার এনে এখানে বসানো হয়। কিন্তু এই কাঠামো গতি সহ্য করতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।”
একজন ডাক্তার বলেন, “প্রতিদিন ৫–৮ জন ব্যাটারি চালিত রিকশা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসে। চালকদের প্রশিক্ষণ দরকার।”
মজিদের বন্ধু হাসান বলেন, “আমরা অনেকেই নিয়ম মানি না, মূল রাস্তায় উঠি, নিজেদের ‘পাইলট’ বলি। তবে এই ব্যাটারিওয়ালা রিকশা দিয়ে আয় বেশি হয়।”
ঢাকা মহানগর পুলিশ এই অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালালে তা প্রতিবাদ ও যানজটে রূপ নেয়।
২০২১ সালে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়, কিন্তু তা এখনো কার্যকর হয়নি। ২০২৩ সালে ব্যাটারি রিকশা নিষিদ্ধ করা হলেও পরে আবার অনুমতি দেওয়া হয়।
বিতর্ক চলছে
কারো মতে, এই রিকশাগুলো সময় বাঁচায় এবং সাশ্রয়ী, অন্যদিকে অনেকে এগুলোকে বিপজ্জনক মনে করেন।
মোহাম্মদপুরের মেহেদি হাসান বলেন, “পথে প্যাডেল রিকশা না পেলে ব্যাটারি চালিতটাই ভরসা। কিন্তু ঝুঁকিটা থেকে যায়।”
ঢাবির সিরাজ আহমেদ বলেন,“প্রযুক্তিগত পরীক্ষা ছাড়া চালাতে দেওয়া উচিত নয়। লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন, সীমিত সংখ্যা — সবই জরুরি।”
ব্যাংকার কায়সার আহমেদ বলেন, “ফাস্ট, আরামদায়ক, সময় বাঁচায় — তাই আমি ব্যাটারিওয়ালাকেই পছন্দ করি।”
তাঁর সহকর্মী রিদিমা হক বলেন, “এদের চালানোর স্টাইল দেখেছেন? দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে মনে হয়।”
প্যাডেল রিকশার পক্ষে সাধারণ মত
শুধু মোটর আছে বলেই ফ্লাইওভার বা ব্যস্ত রাস্তায় চলবে — এটা হতে পারে না।
অবিবেচনাপূর্ণ এই পরিবর্তনে আব্দুল মজিদদের পক্ষে খুব কম লোকই রায় দেয়।
চালকদের স্পিড কন্ট্রোল শেখাতে হবে। রিকশা চালানো মানেই রেসিং না।
আব্দুল ভাইয়ের সেই দিনের কথা মনে হলে, তাঁর রিকশার স্টাইলেও মজা ছিল, কিন্তু কখনও বেপরোয়া ছিল না। তাঁরা তাঁদের সীমা জানতেন।
এখন সময়সচেতন যাত্রীরা ব্যাটারি রিকশার ঝুঁকি ভুলে যান। চালককেও থামাতে বলেন না। এতে যাত্রী ও চালক মিলেই শহরের ট্র্যাফিক সিস্টেম এলোমেলো করে দিচ্ছেন।
তাই আমি বলব — আসুন, আমাদের বাংলা রিকশাকে আবার রাস্তায় ফিরিয়ে আনি।