॥ ইসহাক বাড়ৈ ॥
মনের সরলতাই ঈশ্বরের দৃশ্যমান দরােজা। হয়তাে তাই এই দুনিয়ায় সব পাপ পাপ নয়, সব পুণ্য পুণ্য নয়। সরলতা, প্রেম ও ক্ষমা প্রতিটি মানুষের কাছে ঐশ্বরিক সান্নিধ্য লাভের চাবিকাঠি। হয়তাে তাই যীশুর অভিনয়ে মানুষের সব অভিনয়, অভিনয় নয়। এমনিভাবে যীশু রূপান্তরিত হন লক্ষ কোটি জনতায়। যীশুর অভিনয়ে ক্রুশবিদ্ধ হন ফাদার জীবন, আর তাকে ক্রুশাহত দেখে গালীলের রমণীদের মতােই অশ্রুপাত করেন সুহাসিনী বিশ্বাস, আজও এই বাংলার মাটিতে। মানুষের দেহে যীশু নেমে আসেন, মানুষের দেহ জুড়েই অশ্রুপাত হয় তার। আজ ক্রুশবিদ্ধ হয় পুরুষ, ক্রুশবিদ্ধ হয় ফিলিপিনাে নারীরাও। যীশু আজ সর্বভূতে, সর্বত্র, সর্ব লিঙ্গে সমাহিত সংগুপ্ত সংস্থিত।
কথিত আছে, যীশুর স্বর্গারােহণের পর গ্রীস রাজনাট্য দল সর্বপ্রথম ক্রুশে Tহত যীশুর অভিনয় জনসমক্ষে প্রকাশ করে। সেই সময় নাট্য আন্দোলনে ক্রুশে হত যীশুর বিষয়টি যত না ছিল আধ্যাত্মিক, তার চাইতে বেশি ছিল রাজনৈতিক। গণতন্ত্রের চিন্তা চেতনায় রেনেসাঁর যুগ তখন জ্বলছে। অকস্মাৎ অতি প্রত্যুষে গােটা এথেন্সে জনরব উঠলাে, ইউপপালক নিহত হয়েছেন। এথেন্সের নাট্য গ্রামে ভীড় যেন উপচে পড়ছে। প্রিয় অভিনেতা ইউপােলককে এক নজর দেখার জন্য। ইউপপালক ছিলেন মূর্তি পূজারী। তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম বিশ্বাসী না হয়েও প্রথম যীশুর চরিত্রে মঞ্চে অভিনয় করেন। তার অভিনয় ছিল চমৎকার, বাস্তব। ক্রুশবিদ্ধ ইউপােলক যখন চীৎকার করে বললাে, “পিতা তুমি ইহাদের ক্ষমা করাে, কারণ ইহারা কি করিতেছে তা জানে না। সেদিনই শান্তিকামী জনতা বুঝলাে-গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে, ঈশ্বর সাধারণ মানুষের পিতারূপে পরিগণিত হলাে, মানব মুক্তির জন্য মানুষের স্বেচ্ছায় রক্তদান ও অদৃশ্য ঈশ্বরের উপস্থিতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বিজাতীয় ইউপােলকের রক্ত-মাংসমজ্জার ধড়েও ঈশ্বরপুত্র যীশু খ্রীষ্ট অবগাহিত হতে পারেন, রূপান্তরিত হতে পারেন পাপিষ্ঠ মানবদেহে। ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান শক্তি ও পাপিষ্ঠ মানবের পঙ্কিল কলংকিত দেহও একাকার হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন সেই প্রত্যুষে ইউপােলকের গর্দাণ ছিন্ন রক্তাক্ত দেহখানিতে না ছিল ধর্ম, না ছিল গণতন্ত্র। সবার কাছে একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছিল: ‘ইউপপালককে হত্যা করলাে কারা এবং কেন?’ এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া গেল অতি সহজেই, ইউপপালকের রক্তাক্ত দেহের একপাশে চম্র কাগজে লেখা ছিল নিম্নলিখিত কথাগুলি: ‘ইউপােলক, দুর্দান্ত সাহস তােমার। রক্ত-মাংসের পাপিষ্ঠ মানুষ হয়ে তুমি পবিত্রতম ঈশ্বরপুত্র প্রভু যীশু খ্রীষ্টের চরিত্রের অভিনয় করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে। তুমি পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে পাপ করেছে, তুমি মহাপাতকী। তােমার শাস্তি মৃত্যু। হাল্লেলয়া সবাই বুঝলাে গ্রীসে নব্য অর্থডক্স মৌলবাদী খ্রীষ্টানদের হাতে নিহত হয়েছে। ইউপােলক যীশুর চরিত্রে অভিনয় করার শাস্তি ঐ সময় ছিল চরম মৃত্যুদণ্ড। পৃথিবীর ইতিহাসে পৌত্তলিকতাবাদী ধর্ম ছাড়া আর কোন ধর্মে ধর্মীয় প্রণেতাদের চরিত্রে অভিনয় করা মনুষ্যমাত্রেরই মহাপাপ বলে আজও কয়েকটি ধর্মেই বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এমনকি কোন ধরনের চিত্র, ভাস্কর্য ও শিল্প গঠন করাও মহা অন্যায় বলে পরিগণিত। খ্রীষ্টধর্মে মধ্যযুগে যীশু খ্রীষ্টের চরিত্রে মানুষের অভিনয় একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। তারা ঐ সময় ধরেই নিত যে, এটি মানুষের করণীয় বিষয় নয়, বরং মানুষ তার অভিনয়ের মাধ্যমে স্রষ্টা বা নবী অথবা ভাববাদীদের পরােক্ষভাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপই করে থাকে। ইসলাম, ইহুদী ও খ্রীষ্টধর্মে এই একই মনােভাব সুদীর্ঘকাল ধরে কাজ করছিল। পৌত্তলিকতাবাদী ধর্মে শিল্প ও ভাস্কর্যের পাশাপাশি অভিনয়ও ছিল একটি আনুষ্ঠানিক রীতি। এমনকি যারা সমাজে ঐ সময় অভিনেতা বা অভিনেত্রী ছিলেন তাদের অভিনয় লােকে দেখতে যেত ঠিকই, কিন্তু তাদের সমাজে কেউ সমীহ করতাে না। বাঙালী সংস্কৃতিতে এটি ছিল আরও মৌলবাদীতায় ঢাকা। ঈশ্বর বা যীশু খ্রীষ্টের মতাে নবীদের চরিত্রের অভিনয় আরবীয়, ইস্রায়েলীয় সংস্কৃতিতে মহাপাপ বলে গণ্য হলেও যখন খ্রীষ্টধর্ম গ্রীস ও রােমায় সভ্যতার সংস্পর্শে আসে, তখন ধীরে ধীরে সেই চিন্তা পরিবর্তিত হয়। অথচ দশ আজ্ঞার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আদেশ: “তুমি তােমার ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে কোন কিছু নির্মাণ করাে না, খেচর ভূচর ও জলচর কোন কিছুর প্রতিমূর্তি নির্মাণ করাে না। রােমীয় সভ্যতাসহ গােটা ইউরােপীয় সভ্যতা ছিল পৌত্তলিকতাবাদী, ফলে খ্রীষ্টধর্ম শুধু শিল্প-ভাস্কর্যে, সাহিত্যে-নাট্যে রূপায়িত হলাে তাই নয়, বরং সাধারণ মানুষদের গীত-নাট্যে ও অভিনয়ে বােদ্ধার প্রাণ খুঁজে পেল, ধর্ম হলাে স্রোতস্বিনী ধারার মতাে। এ যাবৎ প্রায় ১৩ সহস্রাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে যীশু খ্রীষ্টের জীবনের উপর, আর সে সবই শুধুমাত্র মঞ্চস্থ হয়েছে লন্ডন থিয়েটার হাউসেই। গােটা ইউরােপে প্যারিস, রােম, প্রাগু, লুক্সেমবুর্গ, জেনেভা প্রভৃতি রাজধানীর মঞ্চগুলাে যদি ধরি, তা হলে এ যাবৎ যীশু চরিত্রে না হলেও প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ অভিনয় করেছে। আর সে সব অভিনয় সাধারণ মানুষের কাছে অতি সহজেই গ্রহণযােগ্য ও বােধ্য হয়েছে। তা হলে কি সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের দুর্বোধ্য চরিত্রের অভিনয়, যীশু খ্রীষ্টের পুণ্যময় জীবনের অভিনয়, বাইবেলের অন্যান্য নবী, সাধু-সাধ্বী, ভাববাদীদের চরিত্রের অভিনয় কোন পাপপ্রযুক্ত কর্ম নয়, বরং ঐশ্বরিক আশীর্বাদ? অসীম প্রেমময় ঈশ্বরের রূপ কি মানুষ তার সসীম পাপ কলঙ্কময় দেহে ফুটিয়ে তুলতে পারে? পবিত্রতার বলয় কি ধ্বংসিত হয় না সেখানে? আসলে সে অভিনয় কি একেবারে সেই অভিনয়, যে অভিনয় গতানুগতিক? না-কি সে অভিনয় অভিনয় নয়, বরং ঈশ্বরের করুণা? অতীতে ইতিহাসে দেখা গেছে, হলিউডের যে সব অভিনেতা যীশু খ্রীষ্টের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তারা এক সাধনার মধ্য দিয়ে সেই পরলৌকিক চরিত্রকে আপন দেহে রূপায়িত করেছেন। পরবর্তী সময়ে সে সব অভিনেতাদের কেউই পুনরায় আর অন্য কোন ছবিতেই অভিনয় করতে চাননি। তাদের অভিনয় জগত থেকে পুরােপুরি একটি বিচ্ছিন্ন জীবনকে মেনে নিতে হয়েছে। এসব অভিনেতা যে সৎ ছিলেন, সাধু ছিলেন তা নয়, বরং অনেকেরই জীবন ছিল কলংকাবৃত। বাঙালী সংস্কৃতিতে ধর্মীয় চরিত্রের অভিনয় সব চাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয় হিন্দু সমাজে। বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘােষের মতাে দুর্বিনীত মানুষের হাতে পড়ে। গিরিশ ঘােষ তার নাট্য জীবজে সব চাইতে বড় পাপটি করেছিলেন নটী বিনােদিনীকে দিয়ে। নটী বিনােদিনী ছিলেন সম সাময়িককালের এমন একজন অভিনেত্রী যাকে সবাই পতিতা বলে ঘৃণা করতাে। নটী বিনােদিনীর ভাষা, ‘মাগী আর বেশ্যা ডাকনাম ছাড়া আমি তাে আর কোন আদর পাইনি ঠাকুর।’…
একদিন মঞ্চে গিরিশ ঘােষ তার জীবনে সেই শ্রেষ্ঠতম পাপটি জোর করে করলেন । গিরিশ ভগবান চৈতন্য দেবের পাঠ করার জন্য নটী বিনােদিনীর মত দেহজ বেশ্যাকে মনােনীত করলেন। নটী বিনােদিনী শ্রীচৈতন্য দেবের অভিনয় এমন নিখুঁত ও চমৎকারভাবে করলেন যে, দর্শকদের মধ্যে দক্ষিণেশ্বর থেকে আগত শ্রীরামকৃষ্ণ নাট্যমঞ্চের ভিতরেই মহা সমাধিস্থ হলেন। অত:পর নটী বিনােদিনীকেই প্রণাম করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ: আরে ভগবান, ওরে ঠাকুর তুই যে কতাে রূপে আসিস। নটী বিনােদিনী সজোরে কেঁদে ফেললেন, বললেন: ‘ঠাকুর, তুমি বেশ্যার ভিতরেও ভগবানের রূপ দেখ।’
সেই থেকে নটী বিনােদিনী আর কোনদিনই অভিনয় করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ তার দেহত্যাগের পূর্বে ত্রিআত্মায় প্রথম নটী বিনােদিনীকে দর্শন দিয়ে ইহলােক ত্যাগ করেছিলেন। ধর্মতত্ত্বের দিক দিয়ে ঈশ্বরের অভিনয়ে মানুষ বা যীশুর অভিনয়ে মানুষ বােধকরি কোনদিনই ব্যাখ্যায়িত, বর্ণনীয় হবার নয়। খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্বের দিক দিয়ে এ সব অলৌকিক চরিত্রের অভিনয়ের যথার্থতা, সঠিক কি বেঠিক, পাপ কি পুণ্য এ সম্বন্ধে পরবর্তীতে কেউ লিখলে লেখা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রােমান কাথলিক চার্চের সাধুদের পবিত্র দর্শন ও জীবনাবলী ধর্মতত্ত্বের যুক্তিমালায় আর ভক্তিতে অনেকাংশে প্রনিধানযােগ্য। আদিতে, মধ্যযুগে এবং এখনাে বেশ কিছু স্থানে প্রােটেস্ট্যান্ট মণ্ডলী এ সব ধর্মীয় নাটক অভিনয়ের বিষয়টি পৌত্তলিকতার সাথেই তুলনা করতাে। মানুষের অন্তরস্থিত ভক্তিই মানসচক্ষে তার ভগবানের স্বরূপ রূপায়িত করে। মানুষের নির্ভেজাল প্রেমই যীশুকে তার মহাপ্রেম নামে হৃদয় মাঝে পরিচিত করে দেয়। এমনিভাবে হঠাৎ করে দুনিয়ার দুর্বোধ্য একেবারেই সহজরূপ বােধ্যে পরিণত হয়। যা আমরা জ্ঞানে যুক্তিতে, বিদ্যায় প্রজ্ঞায় খুঁজে না পাই, তা সহজেই পেয়ে যাই মনের সরলতায়। মনের সরলতাই ঈশ্বরের দৃশ্যমান দরােজা। হয়তাে তাই এই দুনিয়ায় সব পাপ পাপ নয়, সব পুণ্য পুণ্য নয়। সরলতা, প্রেম ও ক্ষমা প্রতিটি মানুষের কাছে ঐশ্বরিক সান্নিধ্য লাভের চাবিকাঠি । হয়তাে তাই যীশুর অভিনয়ে মানুষের সব অভিনয়, অভিনয় নয়। এমনিভাবে যীশু রূপান্তরিত হন লক্ষ কোটি জনতায়। যীশুর অভিনয়ে | ক্রুশবিদ্ধ হন ফাদার জীবন, আর তাকে ক্রুশাহত দেখে গালীলের রমণীদের মতােই অশ্রুপাত করেন সুহাসিনী বিশ্বাস, আজও এই বাংলার মাটিতে । মানুষের দেহে যীশু নেমে আসেন, মানুষের দেহ জুড়েই অশ্রুপাত হয় তার। আজ ক্রুশবিদ্ধ হয় পুরুষ, ক্রুশবিদ্ধ হয় ফিলিপিনাে নারীরাও। যীশু আজ সর্বভূতে, সর্বত্র, সর্ব লিঙ্গে সমাহিত সংগুপ্ত সংস্থিত। এই বাংলায় যীশুর অভিনয়ে মানুষ নয়, গােটা মাঠ-ঘাট-প্রান্তর জুড়ে, খালে-বিলে-নদীতে-বন্দরে লক্ষ লক্ষ যীশু কুশারােপিত। পাপে-পুণ্যে, জ্ঞানে-নির্জনে, অবহেলায়ভক্তিতে, প্রার্থনায় অথবা খ্রীষ্টানদের দলাদলিতে, কাপুরুষতায় অথবা সাহসে যীশু মানুষেরই মাঝে, মানুষেরই একজন, যীশু নামেই যীশু অভিনীত। এই বড়দিনে বিভিন্ন স্থানে হয়তাে যীশুর জন্মের কাহিনী অভিনীত হবে, ছােট শিশুরা অতি আগ্রহে বড় বড় চক্ষে চেয়ে দেখবে: মানুষের মাঝেই মানুষ যীশুকে। দুর্বোধ্য, ঈশ্বর এমনিভাবে আরও সহজতর হবে, হবে মানুষের মনেরই সহজলভ্য, সরলতার প্রাপ্তিতে |
পরিচিতি
প্রকাশিত বই সমুহের প্রচ্ছদ ও প্রকাশকাল
আরো পড়ুন-
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী নিয়ে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’
থিয়েটার সন্দীপনার যাত্রা নাটক “আসেন প্রভু বারে বারে” মঞ্চস্থ