মুহাম্মদ আসাদ : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রীর নাম প্রমীলা নজরুল ইসলাম। পরিবার প্রদত্ত নাম আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দোলোনা সংক্ষেপে দুলী। ‘প্রমীলা’ নামটি কাজী নজরুল ইসলামের দেয়া। পরবর্তীকালে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলা নজরুল, প্রমীলা দেবী, প্রমীলা সেনগুপ্ত ইত্যাদি নামে পরিচিতি লাভ করেন।
মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা গ্রামে প্রমীলা সেনগুপ্তার জন্ম। পিতার নাম বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত। মায়ের নাম গিরিবালা সেনগুপ্তা ওরফে গিরিবালা দেবী। মা ও বাবা একই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের আরও দু’ভাই ছিলেন। তিনি ছিলেন মধ্যম। জগত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। প্রমীলা সেনগুপ্তা বাঙলা ১৩১৫ সালের ২৭ বৈশাখ (১০ মে ১৯০৮) জন্মগ্রহণ করেন। কবি আবদুল কাদির সাহেব ‘নজরুল প্রতিভার স্বরূপ’ গ্রন্থে (পৃ: ৬৭) তাঁর জন্মতারিখ উল্লেখ করেছেন ১৭ বৈশাখ, বাংলা ১৩১৬। চুরুলিয়ায় প্রমীলার সমাধি গাত্রে তাঁর জন্ম ২৭ বৈশাখ ১৩১৫ উল্লেখ আছে। কবি আবদুল কাদির সাহেবের গ্রন্থ থেকে জানা যায় ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত তেওতা গ্রামে আশালতার জন্ম হয়। তাঁর ডাক নাম ছিল দোলোনা দেবী। গুরুজনরা আদর করে ডাকতেন দুলী। বলে। কৈশোরে তার গাত্রবর্ণ ছিল চাঁপাকলির মতো। নজরুল জেলে থাকতে চম্পাকান্তি দোলোনা দেবীকে স্মরণ করেই তাঁর দ্বিতীয় কাব্যের নামকরণ করেছিলেন ‘দোলন-চাঁপা’ (আশ্বিন ১৩৩০)। আশালতার পিতা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যে নায়েবের পদে চাকরি করতেন। তিনি অকালে পরলোক প্রাপ্ত হলে বিধবা গিরিবালা দেবী অনূড়া আশালতাকে নিয়ে কুমিল্লা চলে আসেন। আশালতার খুল্লতাত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত কুমিল্লার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন।’
মোঃ আজহারুল ইসলাম সম্পাদিত ‘মানিকগঞ্জের শতমানিক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন কুমিল্লার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায় বাহাদুর ড. উমাকান্তের পেশকার। কর্মসূত্রেই তিনি কুমিল্লাতেই থাকতেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তকেও তিনি কুমিল্লা কোর্টে চাকরি যোগাড় করে দেন। দু’ভাই মিলে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে একই বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন। তবে প্রতিবছর পূজার সময় অন্যান্য প্রবাসী বাবুদের মতো তারাও পরিবার ও পরিজন নিয়ে নিজ গ্রামে আসতেন।
১৯৬৬ সালে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান কবি এ. এস. এম. আবদুল জলীলের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন প্রমীলার জন্মস্থান তেওতা গ্রাম সফর করি। প্রমীলার পৈতৃক ভিটায় পৌঁছে আমরা তার ফুপাতো ভাই প্রবোধ চন্দ্র দাশগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি তখন তেওতা ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার। তিনি এবং দুলী (প্রমীলা) প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। প্রবোধ বাবু দুলী সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রদান করেন। দুলী খুব চঞ্চল ছিল। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত তেওতা গ্রামেই সে লেখাপড়া করেছে। তার পিতার মৃত্যু হলে তার মা গিরিবালা দেবী চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন। এই পরিস্থিতিতে তার চাচা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত দুলী ও তার মাকে কুমিল্লায় নিয়ে যান। দুলীদের বাড়িতে তখনও তার পিতার নির্মিত মাটির বেড়া দেয়া ৪টি দু’চালা টিনের ঘর ছিল। দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে দুলী তার মায়ের সঙ্গে থাকতো বলে প্রবোধ বাবু আমাদের জানান। প্রমীলা সেন ১৯২০-২১ সালে তার মা গিরিবালা দেবীর সাথে কুমিল্লায় তার চাচার বাসায় আসেন। প্রমীলা তখন ১২/১৩ বছরের এক কিশোরী। পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের অনুরোধে এবং অর্থানুকূল্যে কাজী নজরুল ইসলামও বাংলা ১৩২৭ সালের চৈত্র মাসে (ইংরেজি ১৯২১) প্রথম কুমিল্লার দৌলতপুরে বেড়াতে আসেন। পূর্বদিন সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে তারা পরদিন সন্ধ্যায় কুমিল্লা পৌঁছেন। রাত হয়ে যাওয়ায় তারাকান্দির পাড়ে অবস্থিত প্রমীলার চাচা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। ইন্দ্র বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আলী আকবর খানের বন্ধু। তিনি কলকাতায় থাকতেন এবং হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আলী আকবর খান ইন্দ্র বাবুর স্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবীকে মা বলে ডাকতেন। সেই সুবাদে নজরুলও তাকে মা বলে ডাকা শুরু করেন। এ বাসাতেই নজরুল প্রথম কিশোরী প্রমীলাকে দেখেন। দৌলতপুর এসে নজরুল ১৩২৮ সালের ৪ আষাঢ় পর্যন্ত আলী আকবর খানের বাড়িতে অবস্থান করেন। দৌলতপুরে খানের এক ভাগ্নি নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে তার প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরপরই রাতের বেলা নজরুল ও আলী আকবর খানের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। নজরুলকে নাকি ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। পরদিন সকালে নজরুল চিরদিনের মতো দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে চলে আসেন। সেখানে সেন পরিবারে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে ঠাঁই পান। এখানে তিনি মোট ২১ দিন অবস্থান করেন। এরপর নজরুল কলকাতা গেলেও বার বার কুমিল্লা আসা-যাওয়া শুরু করেন। দুর্গাপূজার সময়ও (১৯২১) তিনি একবার কুমিল্লা আসেন। এ যাত্রায় প্রায় মাসখানিক তিনি প্রমীলাদের বাসায় থাকেন। ১৯২২ সালে তৃতীয়বার নজরুল কুমিল্লায় আসেন এবং ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কুমিল্লায় অবস্থান করেন। এ সময় কুমারী প্রমীলার সঙ্গে তাঁর গভীর প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সমসাময়িককালে রচিত ‘বিজয়িনী’ কবিতাতে এই প্রেমের ¯িœগ্ধ জলছায়া পড়েছে।
হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী।
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এ হার মানা হার পরাই তোমার কেশে।
কবি নজরুল তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দোলন চাঁপা’ প্রমীলার নামে উৎসর্গ করেন। ১৩৩০ সালের আশ্বিন মাসে ‘দোলনচাঁপা’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এভাবেই নজরুল প্রমীলার সম্পর্ক অগ্রসর হতে থাকে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূতকেতু’র পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা প্রকাশের জন্য নজরুলের এক বছর কারাদ- হয়।
১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল কারামুক্ত হয়ে আবার কুমিল্লা আসেন। এ সময় তাঁর প্রতি সেন পরিবারের সৌহার্দ্য ও ভালবাসা আরও বৃদ্ধি পায়। এই প্রসঙ্গে শৈলসুতা দেবীর মন্তব্য : বরং এই বারে সেই সৌহার্দ্য এত নিবিড় হইয়া উঠিল যে, তাঁর সহিত আশালতার বিবাহ দিবার জন্য গিরিবালা দেবী উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন।’ কিন্তু এই প্রস্তাবে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বিরজা সুন্দরী দেবী এবং তাদের পুত্র বীরেন্দ্র সেন গুপ্তসহ পরিবারের অন্য সকলেই অমত প্রকাশ করেন। এই পরিস্থিতিতে গিরিবালা দেবী কন্যাকে নিয়ে বিহারের সমস্তিপুরে ভাইদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কলকাতা হয়েই যেহেতু সমস্তিপুর যেতে হবে নজরুলও তাদের সঙ্গী হলেন।
এ প্রসঙ্গে নজরুলের বন্ধু নলিনীকান্ড সরকারের বক্তব্য নি¤œরূপ : ‘বৌ বাজার স্ট্রিটে চেরী প্রেসের বাড়িতে তখন আমরা থাকি। নিচে ছাপাখানা। দোতলায় নারায়ণ, বিজলী প্রেস ও ছাপাখানার অফিস। তেতলায় থাকি আমরাÑ যারা নারায়ণ ও বিজলী প্রেস চালাতাম। আমাদের সঙ্গে ঐ বাড়িতেই একটি স্বতন্ত্র ঘরে থাকেন শ্রী অরবিন্দের ভগ্নি শ্রীমতি সরোজিনী দেবী। একদিন সন্ধ্যাকালে নিচের উঠোন থেকে আমার নাম ধরে উচ্চ স্বরে নজরুলের কণ্ঠধ্বনি। জানতাম নজরুল কুমিল্লায়। হঠাৎ তার আওয়াজ পেয়ে নিচে নেমে গিয়ে দেখি, দরজার সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আর অদূরে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি ঘোড়ার গাড়ি। নজরুল জনান্তিকে বললেনÑ কুমিল্লা থেকে একজন মহিলা আর তার মেয়ে আমার সঙ্গে এসেছেন, যাবেন সমস্তিপুরে। দু’চারদিন কলকাতায় থাকবেন, তোমাদের এখানে তাদের থাকবার একটু ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সরোজিনী দিদির সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের নিয়ে এলাম তেতলায়। সরোজিনী দিদির ঘরেই তাদের স্থান হলো। তাদের আমাদের বাড়িতে রেখে নজরুল গিয়ে রইলেন ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে ‘মোসলেম ভারত’ অফিসে। সেখান থেকে মাঝে মাঝে এসে তাদের তত্ত্বাবধান করে যেতেন। এই নবাগতা মহিলা এবং তার কুমারী কন্যা হলেন যথাক্রমে নজরুলের ভাবী শ্বশ্রুমাতা শ্রী গিরিবালা দেবী এবং ভাবী ভার্যা শ্রীমতি প্রমীলা ইসলাম।’
বীরেন্দ্র কুমার সেন গুপ্ত প্রমীলা নজরুলের বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি পত্রিকায় একটি বিবৃতি দেন এভাবে ‘মুসলমানের সহিত খুল্লতাত তনায়ার বিবাহে তাহার আদৌ সহানুভূতি নাই, তাহার খুড়ীমা গিরিবালা দেবী, তাহার এবং তাহার পরিবারের অপর সকলের সম্পূর্ণ অমতে মুসলমানদের কন্যাদান করিতেছেন। এজন্য তিনি খুড়ীমার সহিত সমুদয় সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইলেন।
এরপর নজরুলের জীবনে সেই মধুরতম মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসে বাংলা ১৩৩১ সালের ২২ বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার। তিনি প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। মুসলিম রীতি অনুসারে নজরুলের সাথে প্রমীলার বিয়ে পড়ানো হয়। ‘মা ও মেয়ে’ উপন্যাসের লেখিকা মিসেস এম রহমান সাহেবার উদ্যোগে কলকাতার ৬ নং হাজী লেনে এই বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়।
এই বিবাহে ব্রাহ্ম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এবং ‘প্রবাসী’ পত্রিকা অফিস থেকে প্রধানত : নজরুল বিরোধিতার জন্য সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’ প্রকাশ করা হয়। নজরুলের এই বিবাহ তার মাতৃসমা বিরজা সুন্দরী দেবী অনুমোদন করেননি এবং বীরেন্দ্র কুমার সেন গুপ্ত ‘বৈকালী’ পত্রিকায় ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন; এ কারণে নজরুল আর কোনদিন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে যাননি।
প্রমীলা স্বভাবতই সরল, ন¤্র-ভদ্র ও বিদুযী ছিলেন। সংসারের হাল ধরতে তার কোন কষ্ট হয়নি। আবার গিরিবালা দেবীও সংসারে যুক্ত হলেন। তিনি সাত্ত্বিক জীবনযাপন করতেন। হিন্দু বিধবার কঠোর নিয়মকানুন পালন করতেন। তবু নজরুলের সংসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেন। এভাবে নজরুল প্রমীলার সংসার চলতে থাকে।
বিবাহের পর আশালতা সেন গুপ্তার নতুন নামকরণ করা হয় ‘প্রমীলা নজরুল ইসলাম। অতঃপর নবদম্পতিকে মিসেস এম রহমান হুগলীতে নিয়ে যান। সেখানে শ্রীভূপতি মজুমদারের সহায়তায় হামিদুন নবী মোখতার সাহেবের একটি বাড়ি ভাড়া করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ বাড়িতেই ১৩৩২ সালে (১৯২৫ খ্রিঃ) প্রমীলা-নজরুলের প্রথম পুত্র আজাদ কামালের (মতান্তরে কৃষ্ণ মোহাম্মদ) জন্ম হয় এবং নবজাতকের আকিকা উৎসব সাড়ম্বরে সম্পন্ন হয়। সেই উৎসবে ডা. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মঈনুদ্দীন হোসায়েন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, পবিত্র গঙ্গা পাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, দীনেশ রঞ্জন দাশসহ বহু খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিক যোগ দিয়েছিলেন। বিয়ের খাওয়া-দাওয়া হয়নি বলে নজরুল তার বন্ধু ও অনুরাগীদের বিরাট ভুরিভোজে আপ্যায়ন করেন। কিন্তু নবজাতকের আয় ছিল মাত্র কয়েক মাস। এরপর হামিদুন নবী মোখতার সাহেবের বাসা থেকে প্রমীলা-নজরুল দম্পতি হুগলীর চকবাজারে রোজভিলা নামক নতুন বাড়িতে ওঠেন। সেখানেও কবি-সাহিত্যিকরা হাজির হতেন। কবির সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও প্রমীলাও তার মা কোনদিন কোন মেহমানকে অভুক্ত বিদায় দেননি।
১৯২৬ সালের ৩ জানুয়ারি নজরুল হুগলী ছেড়ে স-পরিবারে কৃষ্ণনগর যান। প্রথমে গিয়ে ওঠেন শ্রী হেমন্ত কুমার সরকারের বাড়িতে। এরপর চাঁদ সড়কের পাশে বিরাট কম্পাউড ওয়ালা একতলা বাংলো ধরনের বাড়িতে থাকেন। বাড়ির নাম প্রেসকটেজ। বাড়ির পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম ও আরামদায়ক ছিল। এই বাড়ির পাশেই ছিল লেখক-সাহিত্যিক আকবর উদ্দিনের বাড়ি। তিনি কৃষ্ণনগর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। কবি পরিবারের সাথে আকবর উদ্দিনের সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল একটি কারণে। আকবর উদ্দিন ছিলেন বিপতœীক। আকবর উদ্দিনের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটক ছিলেন প্রমীলা ও নজরুল। হুগলীতে থাকাকালীন সময় প্রতিবেশী আখতারুন্নেসার সাথে আকবর উদ্দিনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। আকবর উদ্দিন বলেছেন, আমার বিয়ের দোলনা (প্রমীলা) প্রায়ই আমাদের বাড়ি এসে আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতেন। আর ১৯২৮ সালের প্রথমদিকে যে আড়াই মাস নজরুল ঢাকায় ছিলেন তখন দোলনা অনেকদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আমাদের বাসায় কাটাতেন।’
কৃষ্ণনগরের এই বাড়িতেই ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রমীলা নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে কবি কৃষ্ণনগর ছেড়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পানবাগান লেনের বাড়িতেই কবির তৃতীয় পুত্র সানি (কাজী সব্যসাচী) জন্মগ্রহণ করেন। পানবাগান লেনের বাড়ি থেকে নজরুল ইসলাম মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের এক দ্বিতল বাড়িতে যান। সেই বাড়িতেই মে মাসের ৭/৮ তারিখে নজরুল প্রমীলার প্রাণ প্রিয় পুত্র (বয়স ২ বছর ৮ মাস) বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়। ১৯৩১ সালে নজরুলের ৪র্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র নিনির (কাজী অনিরুদ্ধ) জন্ম হয়।
প্রমীলা নজরুল ৩০ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তার নি¤œাংগ অবশ হয়ে যায়। রোগ সারানোর জন্য কবি নজরুল কোনো চিকিৎসাই বাদ রাখেননি। প্রমীলার প্রতি নজরুলের কতটা দরদ ও প্রেম ছিল সে সম্পর্কে অনেক নজরুল গবেষকও অবগত নন। দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, সাধু-সন্ন্যাসীর মন্দির, পীর-ফকির, তাবিজ-কবজ, মাবার, পানিপড়া এসব নিয়েও কবি প্রমীলাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। কবি জসীম উদদীনের বিবরণী থেকে জানা যায় কোনো এক দরবেশের পরামর্শে নজরুল শত বছরের কচুরী পানাভর্তি এক পচাডোবায় সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শরীর নিমজ্জিত রেখে অতঃপর দরবেশের তাবিজ নিয়ে প্রমীলাকে দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। আমৃত্যু (৩০ জুন ১৯৬২) প্রমীলা ঐ অবস্থাতেই নজরুলের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রমীলার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে নজরুলের জন্মভূমি চুরুলিয়ায় দাফন করা হয়।
কবি ভালোবেসে ছিলেন তার প্রেয়সী প্রমীলাকে। তেমনি ভালোবেসেছিলেন প্রমীলার জন্মভূমি ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা তেওতা গ্রামকে। নজরুল তেওতা গ্রামকে নিয়ে ‘ছোট হিটলার’ নামে এক অনবদ্য কবতিা রচনা করেন। কবির দু’ পুত্র সানি ও নিনির মুখ দিয়ে বলা হয়েছে :
মাগো! আমি যুদ্ধে যাবোই নিষেধ কি মা আর মানি
রাত্রিতে রোজ ঘুমের মাঝে ডাকে পোলান্ড-জার্মানি,
ভয় করি না পোলিশদেরে জার্মানির ঐ ভাঁওতাকে
কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামা বাড়ি ‘তেওতা’কে।