মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
আধুনিক বিজ্ঞানের এবং শিক্ষার সব শাখার মূল গোড়ায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে! বিখ্যাত ঐতিহাসিক গীবন বলেন যে, লন্ডনের রাস্তা যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকত তখন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল তীর্থকেন্দ্র কর্ডোভার রাজপথ আলোয় উদ্ভাসিত থাকত। বিখ্যাত ঐতিহাসিক হিট্টি যথার্থই বলেছেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত আরবরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি এবং সভ্যতার আলোকবর্তিকা ছিল।“


মুসলিমদের যুগান্তকারী আবিষ্কার অসংখ্য, তার মধ্যে ১০ টি দেওয়া হলঃ

১. বীজগণিত :

বীজগণিতের ওপর প্রথম গ্রন্থটি রচনা করেন পার্সিয়ার বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি, সপ্তম শতকে তার রচিত গ্রন্থটির নাম ‘আল জাবর ওয়াল মুকাবলা, এ বইটি থেকেই মূলত বীজগণিত বা অ্যালজেবরা নামের উৎপত্তি। তার রচিত বীজগণিতের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক গণিতের যাত্রা শুরু হয়। গাণিতিক সংখ্যার বাইরে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে অঙ্ক ধারণা তার মাথা থেকেই আসে। আল খোয়ারিজমিই প্রথম গণিতবিদ যিনি সংখ্যার ওপর ‘পাওয়ার’-এর প্রবর্তন করেন। লগারিদম এর সকল সূত্রাবলি সর্ব প্রথম আল-হারজেম নামক মুসলিম বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন।

২. জ্যোতির্বিজ্ঞানঃ

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্মদাতা হচ্ছে মুসলমানরা! অ্যাস্ট্রোনোমি ম্যাগাজিন (Astronomy Magazine) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে তারা স্পষ্ট স্বীকার করেছে- আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্মদাতাই হচ্ছে মুসলমানরা। প্রতিবেদনে বলা হয়- ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন ঘন অন্ধকারে নিম্মজিত ছিলো, তখন মুসলমানরা জ্ঞানচর্চার শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রায় ১৩শ’ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দেয়।

৩. সার্জারি :

সার্জারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অপরিসীম। আনুমানিক ১০০০ সালের দিকে বিশ্বনন্দিত সার্জারি চিকিৎসক ছিলেন আল জাহরাওয়ি। তিনি সার্জারির ওপর প্রায় পনেরোশ’ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তী পাঁচশ’ বৎসর পর্যন্ত এ বইটি ইউরোপে সার্জারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনিই সর্বপ্রথম সিজার অপারেশন করেছিলেন এবং শল্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফরসেপ বা চিমটে জাতীয় অস্ত্র উদ্ভাবন করেন।

৪. কফি :

নবম শতকের দিকে ইয়েমেনবাসী প্রথম কফি উৎপন্ন করে। প্রথম প্রথম সুফিরা রাত জেগে ইবাদত করার জন্য কফি ব্যবহার করতো, পরে একদল শিক্ষার্থীর মাধ্যমে এ কফি মিসরের রাজধানী কায়রোতে আনিত হয়। পরে সমগ্র আরব বিশ্বে এ কফি ছড়িয়ে পড়ে। ত্রয়োদশ শতকের দিকে কফি তুরস্কে পৌঁছে। ষোড়শ শতকের দিকে কফি ইউরোপে প্রবেশ করে। যে কফির কাপে চুমুক না দিলে অনেকের দিন শুরু হয় না সে কফিই মুসলমানরা প্রথম উৎপন্ন করে।

৫. ফ্লাইং মেশিন :

বিশিষ্ট মুসলিম বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস ওড়ার যন্ত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন এবং সেটির সাহায্যে তিনি আকাশে উড়তে সমর্থ হয়েছিলেন। নবম শতকের দিকে তিনি পাখির আকৃতির মতো বিশাল একটি কষ্টিউম তৈরি করেন এবং স্পেনের কর্ডোভার মসজিদের মিনার থেকে এ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি শূন্যে ঝাঁপ দেন এবং কিছু সময় আকাশে উড়তে সক্ষম হন। তাই বলা চলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আগেই তিনি আকাশে উড়ার বিরল কৃতিত্ব দেখান।

৬. বিশ্ববিদ্যালয় :

আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম মুসলিম দেশ মরক্কো। ৮৫৯ সালে প্রিন্সেস ফাতেমা আল ফিরহি মরক্কোর ফেজে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সনদ দেয়া হতো। পরবর্তীতে প্রিন্সেস ফাতিমার বোন মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে পুরো কমপ্লেক্সটি বা প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় কারুইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদটির নাম হয় আল কারুইয়িন মসজিদ। প্রায় ১২০০ বৎসর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্বমহিমায় টিকে আছে। বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

৭. ক্যামেরা ও অপটিকস বা আলোকবিদ্যা :

মুসলমানদের দ্বারাই আধুনিক আলোকবিদ্যার শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। এক হাজার সালের দিকে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পদার্থবিদ ইবনে আল হাইছাম প্রমাণ করেন যে, বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলো মানুষের চোখে প্রবেশের পরই কেবল মানুষ সে বস্তু দেখতে পায়। তার এ মতবাদ ইউক্লিড ও টলেমির ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দেয়। এ দু’জন বলেছিলেন, চোখের নির্গত আলো দ্বারাই কেবল মানুষ কোনো বস্তু দেখতে পায়। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পদার্থবিদ ইবনে আল হাইছাম মানুষের চোখের সাথে ক্যামেরার সাদৃশ্যও আবিষ্কার করেন।

৮. টুথব্রাশ :

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁতকে সুস্থ, সতেজ ও পরিষ্কার রাখার জন্য নিয়মিত মেসওয়াক ব্যবহার করতেন। পরবর্তী সময়ে এ মেসওয়াকই বিবর্তিত হয়ে আবিষ্কার হয় টুথব্রাশ।

৯. গাড়ির স্টিয়ারিং :

গাড়ি কিংবা যানবাহনে স্টিয়ারিং অপরিহার্য, আর মুসলমানরা এ স্টিয়ারিং আবিষ্কার করেন। বলা চলে এ আবিষ্কারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেছে। বর্তমানে এ স্টিয়ারিং কেবল যান চলাচলেই ব্যবহৃত হচ্ছে না বরং ভারী জিনিসপত্র উত্তোলনের কাজেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২ শতকে আল জাবারির আবিষ্কৃত এ প্রযুক্তি বিশ্বের প্রায় সকল যান্ত্রিক যানবাহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১০. হাসপাতাল:

আধুনিক বিশ্বে রোগীর চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতাল ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন মুসলমানরা। নবম শতকে মিসরে এ হাসপাতাল ব্যবস্থার সূচনা হয়। ১৮৭২ সালে আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয় মিসরের রাজধানী কায়রোতে। বিনামূল্যে এ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো। কায়রো থেকেই পরবর্তীতে এ ধরনের হাসপাতাল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

এবি/ টিআর ১৩-৭-২০১৯
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here