ড. এ. এইচ. এম. রায়হান সরকার

সম্প্রতি উজানি ঢলের সঙ্গে ভারত থেকে একটি বন্য হাতি বাংলাদেশে চলে এসেছে। এটি এখন যমুনার চরাঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে। এ ছাড়া প্রায়ই বন্য হাতি লোকালয়ে চলে আসার খবর ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়। কেন এমন হয়, এসব হাতির সঙ্গে কী করা উচিত তা জানা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ট্রন্ডহেইম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নরওয়েজিয়ান সরকারের অর্থায়নে ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মানুষ বনাম বন্য হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বনাঞ্চলে একটি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, মানুষ ও বন্য হাতির মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব নিরসন একটি রাজনৈতিক ইস্যু। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বন্য হাতি অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে বা সীমানাসংলগ্ন লোকালয়ে যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে, তারাই মূলত বন্য হাতি সৃষ্ট ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের অভিযোগ বেশি করছে। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত এসব জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই আগে কৃষিকাজ বা মত্স্য আহরণ সম্পর্কিত পেশায় জড়িত ছিল। বনসংলগ্ন এলাকায় পুনর্বাসিত হওয়ার পর এসব জনগোষ্ঠী বনের অভ্যন্তরে কিংবা বনের সীমানাসংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে চাষাবাদ শুরু করে এবং বিভিন্ন বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করে তা নিকটস্থ বাজারে বিক্রির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। ফলে একসময়ের বন্য হাতির সমৃদ্ধ আবাসস্থল দিনকে দিন সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে বনমুখী জনবসতির পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিণামে মানুষের সঙ্গে বন্য হাতির মুখোমুখি সংঘাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশে সরকার তথা বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আইইউসিএন বাংলাদেশ মানুষ বনাম বন্য হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে দেশি ও বিদেশি অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পে মূলত বন্য হাতি অধ্যুষিত বনসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণকে বন্য হাতি সংরক্ষণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফসলের মাঠ ও বসতবাড়ির আশপাশে বন্য হাতির বিচরণ রোধে বিভিন্ন দেশীয় কৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তি স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে ফসল নষ্ট ও জীবনহানির ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বন্য হাতির চলাচলের জন্য করিডর চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি চলছে পরিবেশ সংরক্ষণে বন্য হাতির ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিবিধ কার্যক্রম। গবেষণা প্রকল্পের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে বন্য হাতির হোমরেঞ্জের আয়তন দিন দিন বেড়ে চলেছে। যেকোনো বন্য প্রাণীর হোমরেঞ্জ বাড়তে পারে যদি না সে আবাসস্থল পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, বাসস্থান ও প্রজননের সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু দেশের যেসব সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন্য হাতির উপস্থিতি আছে, সেসব বনাঞ্চলের আয়তন হাতির স্বাভাবিক হোমরেঞ্জের তুলনায় অনেক কম। আর এ কারণেই বনসংলগ্ন লোকালয়ে বন্য হাতির উপস্থিতির খবর প্রায়ই স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেখা যায়।

বিদ্যমান দ্বন্দ্ব নিরসনে মানুষ ও বন্য হাতির সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে আমাদের দুটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। প্রথমত, বন্য হাতির বর্তমান হোমরেঞ্জের আয়তন কমিয়ে আনতে হবে, যা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বন্য হাতির হোমরেঞ্জ কমিয়ে আনা মানে বনের অভ্যন্তরে বন্য হাতির মূল আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে, যাতে করে বন্য হাতির চলাচল প্রাকৃতিকভাবে ওই সব এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মোট কথা হলো, বন্য হাতির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোয় বন্য হাতির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য, নিরাপদ বাসস্থান ও প্রজননের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বন্য হাতির মূল আবাসস্থলের উন্নয়ন করতে হলে হাতি অধ্যুষিত বনসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী জনগণের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে, যা প্রকৃত অর্থেই বেশ জটিল ও সময়সাধ্য বিষয়। স্থানীয় জনগণের বননির্ভরতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে পর্যায়ক্রমে বয়সভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি কারিগরি শিক্ষা প্রোগ্রামের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। হাতি অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা থেকে বনের বাইরের দিকে কমপক্ষে দুই কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো ধরনের চাষাবাদ, ইটের ভাটা ও বসতি স্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তন অনেকটাই দুরূহ ব্যাপার।

মানুষ বনাম বন্য হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে আমাদের দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে তা হলো, বন্য হাতি সৃষ্ট ফসলের ক্ষয়ক্ষতির প্রতি বনের ভেতরে বা বনসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতা বাড়ানো। বনসংলগ্ন গ্রামীণ সমাজে বসবাসকারী জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে বন্য হাতি সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির প্রতি স্থানীয় জনগণের ধৈর্য ও সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধির আরো বেশি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বন্য হাতির প্রতি হাতি অধ্যুষিত বন এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় জনগণের সহানুভূতি তৈরি করতে হলে সর্বপ্রথমে বন্য হাতির প্রতি যে ভীতি তাদের আছে তা দূর করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বন্য হাতির স্বভাব ও পরিবেশ সংরক্ষণে বন্য হাতির ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বন্য হাতি অধ্যুষিত বনসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় জনগণকে জানতে হবে বন্য হাতিকে এড়িয়ে চলার কৌশল। বন্য হাতি সম্পর্কিত সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের পাশাপাশি প্রয়োজনে ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

দেশে বন্য হাতির সংখ্যা নিরূপণে আইইউসিএন বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় বন্য হাতি অধ্যুষিত দেশের ১২টি বন বিভাগে জরিপ চালাচ্ছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের প্রাথমিক বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে দেশের বনাঞ্চলে বন্য হাতির সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। যদি তা সত্য হয়, সে ক্ষেত্রে বন্য হাতি অধ্যুষিত বনাঞ্চলে ইকোট্যুরিজম চালু হলে পর্যটকদের নেতিবাচক আচরণ ও অসংযত চলাচল বন্য হাতির বিরক্তির কারণ হতে পারে, যা প্রকারান্তরে বন্য হাতির প্রজনন কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। হাতিকেন্দ্রিক ইকোট্যুরিজম চালুর ক্ষেত্রে ক্যাপটিভ কন্ডিশনে যেসব হাতি রয়েছে, তাদের একত্রিত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে সংশ্লিষ্ট হাতির মাহুতরাও আয়-রোজগারের একটি পথ খুঁজে পাবে বলে মনে করি।

বনসংলগ্ন লোকালয় ও ফসলের ক্ষেত থেকে হাতি তাড়ানোর যে প্রচলিত প্রথা স্থানীয়ভাবে চালু আছে, তার বেশির ভাগই বর্তমানে অকার্যকর বলে গবেষণায় দেখা গেছে। আধুনিক ও প্রচলিত পদ্ধতির সমন্বয়ে লোকালয় থেকে বন্য হাতি তাড়ানোর কৌশলগুলো মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে প্রতিটি পদ্ধতির দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আলাদাভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার তথা বন বিভাগের উচিত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া আরো প্রমাণসমৃদ্ধ, তথ্যবহুল ও ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনা। বিশেষ করে ফসলের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে কমপক্ষে এক বছর অপেক্ষা করা উচিত। এতে করে ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগকারীর সংখ্যা কমে আসতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ ও বন্য হাতির মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে মানুষ ও বন্য হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে যতই উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক না কেন, কার্যত তা সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হবে।

লেখক : বন্য হাতি গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক,

ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here