বিশ্বজিৎ বড়ুয়া : গত ৬ মে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সারাদেশে এবারের পরীক্ষায় এসএসসি, মাদ্রাসা ও কারিগরিতে পাসের হার যথাক্রমে ৮২ দশমিক ৮০, ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ ও ৭২ দশমিক ২৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। গত বছরের চেয়ে এবারের গড় পাসের হার বেশি আমাদের বোয়ালখালীতে।

লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষক ও অভিভাবক ব্যস্ত থাকেন কি করে তাঁদের সন্তান জিপিএ-৫ পাবে। অনেক অভিভাবকের ধারণা, তার সন্তানের জিপিএ-৫ না পাওয়ার অর্থই হল ওই শিক্ষার্থী জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না ! এমন ধারণা যে একেবারেই ভিত্তিহীন তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে।

সম্প্রতি আরো লক্ষ্য করা গেছে, এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারী অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। এ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়, এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান সেইভাবে বাড়ছে না। কাজেই শিক্ষার গুণগত মান কিভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবার প্রতি রইল অভিনন্দন। যারা উত্তীর্ণ হতে পারোনি তারা হতাশ না হয়ে আগামীতে যাতে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

গুণগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য ৬টি নির্দেশকের উপর নির্ভরশীল। তা হল : (১) শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা সৃষ্টি করা (২) শিক্ষার্থী যা করে তা বুঝতে পারা (৩) শিক্ষার্থীর নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হওয়া (৪) সামাজিক দায়বদ্ধতা (৫) কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা তৈরী করা (৬) শিক্ষার্থীর সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।

এই ৬টি নির্দেশক একজন শিক্ষার্থী অর্জন করতে পারলে তবেই গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হবে। এ নির্দেশক বাস্তবায়নে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন। যা বর্তমান সরকারের ভিশন। শিক্ষা পরিবারের সর্বোচ্চ স্তরের নীতি নির্ধারক মহল বর্তমানে গুণগত শিক্ষা অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন এবং বাস্তবায়নে তৎপর।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বছরের প্রথম দিন থেকে শিক্ষাপঞ্জি শুরু। শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়া এবং সরকারের নেওয়া নানা কর্মসূচী দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার মান। এজন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক ও আধুনিক শ্রেণিকক্ষ। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে।

আজকের শিক্ষার্থীরাই দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ। দেশের সেই ভবিষ্যৎ নাগরিককে গড়ে তোলার দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের মান হতে হবে উচ্চ। বরাবরের মতো এবারের ফলাফল পর্যালোচনায়ও দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। মেয়েরা ভালো ফল করছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোর মান বৃদ্ধি করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত আবশ্যক।

বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারি সিদ্ধান্ত প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তারই ধারাবাহিকতায় বোয়ালখালীর প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বহু ঐতিহ্যে ঋদ্ধ কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণ।

বিপ্লবতীর্থ বোয়ালখালীর ক্রীড়া ও সংস্কৃতির তীর্থ কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর এ বিদ্যালয় সরকারিকরণ ও গেজেট প্রকাশিত হয়। সকলের সাথে বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার এই বিদ্যালয় উত্তরোত্তর সাফল্য লাভ করে।

যে আলোকবর্তিকা নিয়ে এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তা আজকে অনেক বেশি উজ্জ্বলতর হয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে এ বিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য।

এ বিদ্যালয়ের শত বছরের মৃৎভবনটি আজ জাতিয় ঐতিহ্যের অংশ। সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটি সংরক্ষণ করছে। এ বিদ্যালয়ের শহিদ মিনার বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। যা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অপেক্ষায়।

বৃক্ষ রোপণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতিয় পুরুস্কার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এটি। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। নান্দনিক প্রাকৃতিক শোভা মন্ডিত প্রকৃতি বান্ধব রবী ঠাকুরের শান্তি নিকেতনরই আরেক রূপ এই বিদ্যালয়।

আজকে এমন একটি বিশেষ সময়ে এসে আমি শ্রদ্ধা চিত্তে স্মরণ করি এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী ও তাঁর পরিবার এবং প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক বিধুভুষন চৌধুরী যার সাংগঠনিক দক্ষতায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে অপরাপর প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক-শিক্ষিকা যাদের সাহচর্য্যে এই বিদ্যালয়ের চাকা সচল ছিল।

এই বিদ্যালয়ের রেঁনেসা যাঁর হাত ধরে হয় তিনি সফল শিক্ষক সংগঠক, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক কাজী আব্দুল গণি ছাবেরী। প্রাচীন ও আধুনিকতার মেলবন্ধন যিনি সৃষ্টি করেছেন বাবু মিলন কুমার চক্রবর্তী বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (সাবেক)।

অনেক কৃতি শিক্ষার্থী ধারণ করেছেন এই বিদ্যাপীঠ। শতবছরের এই বিদ্যালয়ের বহু কৃতি শিক্ষার্থী পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় স্ব-মহিমায় অবস্থান করছেন। বিদ্যালয়ের প্রতি আন্তরিকতার এতটুকু ছেদ পড়েনি। জনাব মইন উদ্দিন খান বাদল এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞ পার্লামেন্টিরিয়ান, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান। যার সু-নির্দেশনায় বিদ্যালয়ের আজকের অবস্থান। যিনি স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছেন।

তিনি দুটো আপ্তবাক্য শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন, ‘কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সদা সত্য কথা বলে এবং এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের জন্য সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত।’ আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।

কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে এলাকাবাসীর নিবিড় সম্পর্ক। বিদ্যালয়কে তাঁরা আপন আলয়ের মতো দেখে শুনে রাখে। কৃতজ্ঞতা জানাই এলাকাবাসীকে।

উপজেলা প্রশাসন ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে এই বিদ্যালয়ের নিবিড় সম্পর্ক। উপজেলা প্রশাসনের যে কোন আনুষ্ঠানিকতায় কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সদা প্রস্তুত।

বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের সু নির্দেশনায় বর্তমান কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর প্রতি।
‘‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, বৈরিতা নয় কারো সাথে’’- এই নীতিতে কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালিত।

আমি ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই, বোয়ালখালীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার কারিগরদের। যাঁরা তৈরী করছেন আগামীর মেধাবী প্রজন্মকে।

সময়ের স্রোতে কেউ থাকবে না পৃথিবীতে কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগ-যুগান্তর। আসুন সবাই মিলে যে-যে অবস্থানে আছি, সেখান থেকে ভালটা করার চেষ্টা করি। তাহলেই আগামীটা হবে সুন্দর।

‘আলোকিত বোয়ালখালী’ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, বস্তনিষ্ট ও সৃজনী কর্মের জন্য। অভিনন্দন জানাই এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন শিক্ষার্থীদের। যারা আগামীর উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের মানবিক মানুষ হওয়ার আহবান জানাই। শুভেচ্ছা সবাইকে।

( লেখক : প্রধান শিক্ষক, কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here