মাহে রমজানের শেষ দশক। মাগফেরাতের দশ দিন পার হয়ে এল মুক্তির সওগাত নিয়ে নাজাতের দশক। এই দশক ইতিকাফেরও দশক। ইতিকাফ হচ্ছে, আল্লাহর নৈকট্য ও ক্ষমা লাভের একটি অনন্য সুযোগ। এই দশ দিনেই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, অনুকম্পা, ক্ষমা ও করুণার আশায় মসজিদে মসজিদে পালন করা হয় ইতিকাফ। রোজাদার মুসলিমরা ইতিকাফ আদায় করে বিশেষ ফজিলত ও পুণ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকেন। মাহে রমজানের প্রতিটি দিনক্ষণ ও মুহূর্ত খুবই দামি ও মূল্যবান। ইবাদত তপস্যা ও আরাধনার মাধ্যমে রোজাদার আল্লাহর দরবারে নিজেকে নিবেদন করতে সক্ষম হলে তবে জীবন হবে ধন্য ও কামিয়াব। বছরে একটি মাস মহিমান্বিত মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা, ইবাদত-আরাধনা, দান-সদকাহ ও জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে রোজাদারকে আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তেমনিভাবে মাহে রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ পালনের সুযোগ গ্রহণ করলে রোজাদারের মর্যাদা বাড়ে ও ভরে যায় পুণ্যের ভান্ডার। ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, কোনো বস্তুর ওপর স্থায়ীভাবে থাকা। ইতিকাফের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয় এবং নিজেকে মসজিদ থেকে বের হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। ইতিকাফ মাহে রমজানের একটি বিশেষ ইবাদত। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের মসজিদে অবস্থান করা অথবা কোনো মহিলার নিজ ঘরে নামাজের স্থানে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করা। ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে মসজিদে মসজিদে মুসলিমরা ইতিকাফের নিয়তে প্রবেশ করে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় মসজিদে পূর্ণাঙ্গ অবস্থান করার মাধ্যমে মুসল্লিরা ইতিকাফের নিয়তে সর্বক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত তসবিহ-তাহলিল, জিকিরে ব্যস্ত সময় কাটায়। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মুতাকিফ বলা হয়। ইতিকাফ যে কোনো সময় করা যায়। যখনই কেউ ই’তিকাফের নিয়তে মসজিদে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবস্থান করেন তখনই তা ইতিকাফ বলে গণ্য হবে। তবে ২০ রমজানের সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল তথা ঈদের চাঁদ উদয় হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করা সুন্নাত। ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার সব রকম ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে একমাত্র তাঁরই ইবাদতে নিবেদিত হয়ে পরিশুদ্ধি অর্জন। মাজহাবের ইমামদের সর্বসম্মত মত হচ্ছে, মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ পালন করা সুন্নাত। হানাফি মাজহাব মতে রমজান শেষ দশ দিনের ইতিকাফ হচ্ছে সুন্নাতে মুআক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ মসজিদের মুসল্লিদের পক্ষ থেকে বা মহল্লার মধ্য থেকে কোনো এক ব্যক্তি ইতিকাফ করলে তা সকল মুসল্লি বা মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশক রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিতভাবে মসজিদে ইতিকাফ করতেন এবং সাহাবায়ে কিরামও ইতিকাফ করতেন। নবীজি ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, কখনো তা ছুটে গেলে ঈদের মাসে আদায় করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। এ আমল তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত কায়েম ছিল। নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণও এ নিয়ম পালন করেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) প্রত্যেক ইতিকাফকারী রোজাদারের আল্লাহর ইবাদত, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ-রোজা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, মোরাকাবা-মোশাহেদা ও তওবা-ইস্তেগফারে ব্যস্ত থাকা এবং পার্থিব বিষয়ে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা থেকে দূরে থাকা অত্যাবশ্যক। ইতিকাফ পালনকালে যেকোনো ধরনের পার্থিব বিষয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবে না, যখন তোমরা মসজিদে ইতিকাফে থাকবে।’ (সূরা আল-বাকারা আয়াত: ১৮৭) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ও অজু ব্যতীত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। অবশ্য এসব কারণ ছাড়াও প্রয়োজনের তাগিদে কারও জীবন রক্ষার্থে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। তবে এ জন্য ইতিকাফের কাজা আদায় করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইতিকাফকারী রোগী দেখতে যাবে না, জানাজায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রী স্পর্শ করবে না। বিশেষ জরুরি কাজ ব্যতীত বাইরে যাবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বছর ইতিকাফ করতে পারেননি, পরবর্তী বছর তিনি ২০ রাত ইতিকাফ করেন।’ (তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিফাক করতেন। তারপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন ইতিফাক করেন।’ (বুখারি) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নত এবং এর ফজিলত অপরিসীম। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করবে, তার জন্য দুই হজ ও দুই ওমরার সওয়াব রয়েছে।’ (বায়হাকি) আরেকটি বর্ননায় নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এক দিনের ইতিকাফ করল, তার ও দোজখের মধ্যখানে আল্লাহ এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমেরও বেশি।’ (তিরমিজি) যে ব্যক্তি ইবাদত মনে করে সওয়াবের নিয়তে ইতিকাফ করেন, তার সব সগিরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। নবী করিম (সা.)-এর ফরমান, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকে আর ইতিকাফে লিপ্ত থাকার জন্য কোনো ব্যক্তি বাইরের কোনো নেক কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেও ওই নেক কাজগুলোর পূর্ণ নেকি সে লাভ করবে।’ (ইবনে মাজা) লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান ও এর ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। জীবনের শেষ রমজান পর্যন্ত তিনি এ সময়কাল পালন করেছেন। মাহে রমজানের শেষ দশক এলে তিনি স্ত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন এবং ইবাদতে মশগুল হতেন। সারা রাত নিজেও জাগতেন এবং পরিজনকেও জাগিয়ে রাখতেন। ইতিকাফের সর্বনিম্ন সময়সীমা এক রাত বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে। তবে ইতিকাফ দীর্ঘ সময় (মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন) ধরে করা উত্তম। কারণ এই ১০ দিনেই নিহিত রয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’ বা হাজার মাসের শ্রেষ্ঠতম ভাগ্যের রজনী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here