ডা. বরুণ কুমার আচার্য
যুগে যুগে এই পৃথিবীতে এসেছেন অসংখ্য মুসলিম মণিষী। তারা আল্লাহ ও নবী রাসুলের প্রতি প্রেমে মগ্ন থেকেছেন। দ্বীন প্রচার ও ইবাদত বন্দেগিতে স্থাপন করেছেন অনন্য সব দৃষ্টান্ত। তাঁদের জীবনের লক্ষ্য ছিল একটিই, আর তা হলো অন্তরে আল্লাহকে ধারণ করা। তাঁদের ডাকে সৃষ্টিকর্তাও সাড়া দিয়েছেন, তৈরি হয়েছে অনন্য উপাখ্যান। আল্লাহর কাছ থেকে তারা পেয়েছেন অনেক অলৌকিক ক্ষমতা। এমনই এক আধ্যাত্মিক প্রেমে মগ্ন আশেক চরণদ্বীপ দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ হযরত শাহ্সুফি মাওলানা শেখ অছিয়র রহমান চরণদ্বীপির (কঃ)। যিনি জনাব মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) নামে পরিচিত।
সুফিজমে বহুল প্রচলিত চর্চাকে ইংরেজিতে বলে মিস্টিসিজম। এর অর্থ হলো মরমি সাধক বা মরমিয়া, সুফি, মুর্শিদ, দরবেশ, সাধু, সন্ন্যাসি, গুরু ইত্যাদি। গ্রিক শব্দ মিসটেস থেকে আসা শব্দটির অর্থ চোখ বন্ধ করা। মরমি সাধকরা চোখ বন্ধ করে অর্ন্তদৃষ্টি ও গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে সত্য ও সুন্দরকে উপলব্ধি করতে সক্ষম। সুফিবাদেরও মর্মকথা হলো হৃদয়ে তোমার চলে যেন আলিফের (আল্লাহ) খেলা।
পবিত্র দৃষ্টি দিয়ে যদি তুমি জীবনকে দেখতে শেখো, তুমি জানবে আল্লাহর নামই যথেষ্ট। আল্লাহতে অনুগত বা লিন হওয়া সুফি সাধকের চরম লক্ষ্য। আর এই কাজই সাধন করেছেন মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ)।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, বিশ্বাসী আল্লাহর নূরকে খোঁজ করবে, কেউ তা অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখবে, যা চর্মচক্ষু দিয়ে পাওয়া যাবে না। জ্ঞান হলো আলো বা নূর যা আল্লাহ যাকে খুশি দান করেন। শারীরিকভাবে কাছাকাছি না থাকলেও সিদ্ধি লাভ হয়। তারই উদাহরণ মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ)। যেহেতু তিনি নবীজী (সা.) কে চর্মচক্ষু দিয়ে না দেখে তাঁর সব শিক্ষাই তিনি পেয়েছিলেন।
এক. জনাব মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) ত্রিশ বছর বয়সে ১৩০০ হিজরীতে খেলাফত লাভ করত: দশ বছর ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ হালতে ভ্রমণ করে মাইজভা-ার দরবার শরীফ উপস্থিত হলেন। হযরত গাউসুল আযম শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভা-ারী (কঃ) তাঁকে বলেন-
‘‘আমি তোমাকে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) এর আসন দিয়েছি। হযরত রাসুল করিম (দঃ) এর পবিত্র চাদর তোমাকে দিয়েছি। তুমি শাহে আলী (কঃ) ও জহুর শানে নুরানী, মাহ্বুবে ছোবাহানী, তোমাকে আমার একটি চক্ষু দিয়েছি। তুমি আমার সূক্ষ্মতত্ত্ব জ্ঞানখনি। তুমি বাদশাহের পুত্র বাদশা, গাউসুল আজমের পুত্র গাউসুল আযম, তুমি যাও আপন গৃহে আমার গদীতে বসে থাক।
সুত্র-জীবনী ও কারামত, প্রকাশ কাল ১৯৭৪ইং, পৃষ্ঠা-১১১)
দুই. চট্টগ্রাম চান্দগাঁও নিবাসী জনাব মৌলভী ওবায়দুল হক শাহ্ (রহ.) হযরত আকদছ কেবলার খেদমতে উপস্থিত হয়ে হযরত মাওলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপির (কঃ) শাণ সম্বন্ধে বাক্যালাপ করলে হযরত কেবলায়ে আলম (কঃ) তাঁকে বলেন-আল্লাহ তায়ালা মাওলানা শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) কে হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রাদিঃ) আসন দান করেছেন, আমি তাঁকে সিদ্দিকের (রাদি) আসনে পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে হযরত আলী (রাঃ) এর গুপ্ত জ্ঞান দান করেছেন। আমি তাঁকে আমার চিন্তাধারার সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞান খনির দ্বার স্বরূপ পেয়েছি। তিনি আমার অলদ, আমি তাঁর ওয়ালেদ (পিতা), তোমাদের (মৌলভী ওবায়দুল হক বয়সী অনুজদের) আরম্ভ হতে পরিসমাপ্তি তাঁর হাতে ন্যাস্ত। আমার ফয়জুল হক মিঞা, গোলাম রহমান, অছিয়র রহমান আমা হতে ভিন্ন নয়। তাঁরা আমার পঞ্জতন।”
সূত্র- জীবনী ও কারামত গ্রন্থ প্রকাশকাল ১৯৭৪ইং, পৃষ্ঠা-১১৩-১১৪।
উল্লেখ থাকে যে, হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) পাক পাঞ্জাতন সদস্য করা তাঁদের নাম সমূহ হযরত কেবলা (কঃ) নিজেই তাঁর পাক জবানে ইরশাদ করেছেন। এ ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় হযরত শাহ্সুফি মাওলানা শেখ অছিয়র রহমান চরণদ্বীপির (কঃ) জীবনী ও কারামত গ্রন্থে।
হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) ওফাত শরীফের পরে কার হাতে কামালিয়তের আরম্ভ হতে পারে সমাপ্তি ন্যস্ত থাকবে তারও নির্দেশনা প্রদান করে দিয়েছেন হযরত কেবলা নিজেই।
হযরত ছোট মাওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আমিনুল হক ওয়াছেল বলেন ‘‘আমি একদা চরণদ্বীপ এসে দেখলাম, আমার জেঠা হযরত গাউসুল আযম (কঃ) ও মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপির (কঃ) মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য পরিলক্ষিত হল না। অঙ্গের অবয়ব, আকৃতি-প্রকৃতি ও চাল-চলন, হাব-ভাব, বাক্যালাপ ইত্যাদি আমার জেঠা হযরত কেবলার সম্পূর্ণ অবয়বতা দর্শনে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম।
সূত্র-জীবনী ও কারামত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১১৭)।
ছোট মাওলানা হযরত সৈয়দ আমিনুল হক ওয়াসেল (কঃ) ও অছিয়ে গাউসুল আযম হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) উভয়ে পরম সত্যবাদী। তাঁরা হযরত শাহে চরণদ্বীপি (কঃ) কে হযরত কেবলার কামালিয়তের চেহেরায় দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
হযরত আকদছ ‘আহমদ উল্লাহ’ নামে খাতেমুল আউলিয়ার ছুরতে শায়খুল আকবর মহিউদ্দিন ইবনুল আরবী (কঃ)’র জামানায় বিদ্যমান ছিলেন। একথা যেমন ‘ফুছুছুল হেকম’ কিতাব হতে শাহ্সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) প্রমান করেছেন। তার পূর্বে খাতেমুল আউলিয়ার বর্ণনা কুতুবে জামান শাহ্সুফি মাওলানা ছফী উল্লাহ্ ছাহেবের (কঃ) পবিত্র জবানে হযরত মাওলানা শাহে চরণদ্বীপি (কঃ) কলিকাতা হয়ে ১২৯৮ হিজরীতে ফেরত কালেও শুনে এসেছেন। তিনি প্রথম অবস্থার মুরিদ ও একমাত্র প্রথম খলিফা হিসাবে গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) মহিমা সর্বত্র প্রকাশ করেছেন। হযরত কেবলার ওফাতের প্রায় বার বছর পূর্ব হতে নিজ বাড়িতে গদীনশীন হয়ে ৭ইমাঘ ওরশ শরীফ (ফাতেহা) চালু করেন যা এখনো বহাল আছে।
তিন. রাউজান গর্শ্চি নিবাসী মাওলানা ছৈয়দ মোহাম্মদ হাছান ছাহেব (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) নিকট বায়াত হওয়ার প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘মিঞা তুমি খাজা মইনুদ্দিন চিশতি আজমেরী (কঃ) এর হাতে বায়াত গ্রহণ কর। আমি বললাম, হুজুর! তিনি যে ওফাত হয়েছেন। প্রতি উত্তরে হযরত আকদছ (কঃ) বলেন, ‘‘মিঞা তোমাকে কে বলেছে খাজায়ে আজমিরী ওফাত হয়েছেন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে চরণদ্বীপ গ্রামে খাজায়ে আজমিরী ছাহেব তোমার জন্য একজাম দুধ নিয়ে বসে আছেন। তোমাকে রোখছত করলাম চলে যাও” বিদায় হওয়ার পর একদা তিনি চরণদ্বীপে উপস্থিত হলেন। জনাব মাওলানা আকদছ (কঃ) আমার দিকে দৃষ্টিপাত করত: মৃদ হাস্যে বলেন-মিঞা খাজায়ে আজমিরী (কঃ) ওফাত হননি। তোমার জন্য দুধের জাম নিয়ে বসে রয়েছেন’’ এই বলে তিনি আমাকে এক চামচ সরবত পান করালেন। তৎপর আমার যে অবস্থা হল আমি তা বলতে পারিনা। বেখুদী অবস্থায় আমি অজ্দ ও রোখ্ছ করেছিলাম।
সূত্র-মাওলানা শাহ্ চরণদ্বীপির (কঃ) জীবনী ও কারামত গ্রন্থ, প্রকাশ কাল ১৯৭৪ইং, পৃষ্ঠা-১২৪)।
চার. বোয়ালখালীর কধুরখীল নিবাসী হযরত মাওলানা ইসমাইল ছাহেব (রহঃ) একদা বায়াত হওয়ার জন্য মাইজভান্ডার শরীফ উপস্থিত হন। হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাঁকে বলেন, ‘মিঞা তুমি হযরত আলী (রাঃ) এর নিকট যাও। তোমাদের নেয়ামত খলিফায়ে উলুল আযম (প্রধান খলিফা) এর হাতে রয়েছে।’ তিনি বললেন, হুজুর! হযরত আলী (রাঃ) কে আমি কোথায় পাব? হযরত কেবলা (কঃ) বলেন, ‘মিঞা চরণদ্বীপ আমি একখানা মসজিদ দিয়েছি, সেই মসজিদে নামাজ পড়লে হযরত আলী (রাঃ) কে পাবে।
সূত্র-জীবনী ও কারামত গ্রন্থ, প্রকাশকাল ১৯৭৪ইং, পৃষ্ঠা-১২২।
এভাবে আরো অনেক জজবাতি কালাম রয়েছে মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) সর্ম্পকে। যা হযরত গাউসুল আজম মাইজভা-ারী (ক.) কুতুবুল আকতাব হযরত বাবাভা-ারী (ক.) মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) সহ হযরতের অপরাপর খলিফাবৃন্দের জীবন কর্মে মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) কে নিয়ে অনেক তথ্য জানা যাবে।
আজ ২৭আগষ্ট ২০২০ তারিখে মাওলানা আকদছ শাহ্ চরণদ্বীপি (কঃ) এর ওফাত শতবার্ষিকী। এতে আমার কৌটিগুণ শ্রদ্ধা ও প্রেমময় ভালবাসা জানাচ্ছি। মুলত ঃ আমরা যেন বাস্তবিক জীবনে হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) প্রকৃত শান আযমত এবং তাঁর সকল খোলাফায়ে কেরাম, বিশেষ করে তাঁর প্রথম ও প্রধান খলিফা হযরত মাওলানা শাহ্ অছিয়র রহমান আল ফারুকীর (কঃ) বেলায়তের তবকা, শান আজমত বুঝার চেষ্টা এবং গবেষণা করে প্রকৃত সত্য অনুধাবন করে পরম শ্রষ্টার মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারি।