পর্ব ৩
(ছ) নির্বিলাস সভ্যতার শরাফত (Simplicity of Life)
নির্বিলাস জীবন যাপন মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ) আচারে ব্যবহারে, আহারে-বিহারে, এমনকি প্রত্যেক কাজের ভেতর দিয়ে নির্বিলাস সভ্যতা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। নির্বিলাস জীবন যাপন সপ্ত-পদ্ধতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বিলাসিতা মানুষের মধ্যে অনর্থকতা সৃষ্টি করে। বিলাসিতা মানুষর মধ্যে অতি ব্যয়ের অভ্যাস সৃষ্টি করে এবং অবিচার, জুলুম, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্ধিতি,
অছি-এ-গাউসুল আ’যম ছিলেন নির্বিলাস জীবন যাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি কনুইর নিম্ন পর্যন্ত লম্বিত সাদা কাপড়ের জামা, সেলাই বিহীন সাদা লুঙ্গি, সাদা টুপী, শীত ও গ্রীষ্মের উপযোগী চাদর এবং পায়ে কাঠের খড়ম ব্যবহার করতেন। তিনি মাটির উপর বিছানায় শয়ন করতে ভালবাসতেন। তিনি আড়ম্বর মোটেও পছন্দ করতেন না। চিঠি পত্রে তিনি ‘খাদেমুল ফোকরা’ বা ‘মিসকিনের সেবক’ পরিচিতি ব্যবহার করতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
“তোমরা জেনে রাখ যে, এ পার্থিব জীবন ক্রীড় ও কৌতুক ভিন্ন নহে এবং এ সাজ-সজ্জ্বা ও পরস্পরের মধ্যে অহংকার এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততির আধিক্য; ইহা বৃষ্টিধারা সদৃশ সব্জী উৎপাদনকারীকে আনন্দ দান করে, তৎপর উহা বিচুর্ণিত হয়ে যায় এবং পরকালে কঠোর শাস্তি এবং আল্লাহর সান্নিধান থেকে মার্জনা ও পরিতুষ্টি রয়েছে এবং এ পার্থিব জীবন প্রতারণার ভান্ডার ব্যতিত নহে”। (সূরা – হাদিদ, আয়াত : ২০)।
(জ) বৈষম্যহীনতা বা বিচার সাম্যের শরাফত (Lack of Discrimination or Judicial Equality)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বশেষে যে কোন স্তরের লোক সুবিচার পাওয়ার যোগ্য। উঁচু-নিচু, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-দরিদ্র এরূপ কোন ভেদাভেদ মাইজভান্ডারী শরাফতে নেই। অছি-এ-গাউসুল আ’যম বিচার সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকার কারণে কোন অন্যায় তাঁর সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ব্যক্তির সাথে মোকাবেলা এবং মুখোমুখি হতেও তিনি কুন্ঠাবোধ করেননি।
(ঝ) সার্বজনিনতা বা বিশ্বমানবতার শরাফত (Universality of Global Humanity)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বমানবতা বা মানবতার কল্যাণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ধর্মসাম্য প্রতিষ্ঠিত করা হলো মাইজভান্ডারী দর্শনের বিশেষ একটি তাৎপর্যময় দিক। মাইজভান্ডারী দর্শনের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা সব কিছুরই ব্যাপ্তি হলো বিশ্বব্যপী। সারা বিশ্বের মানুষের কল্যাণ ও ঐক্যে মাইজভান্ডারী দর্শন বিশ্বাসী। আজ মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে যে অশান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে তার প্রধান কারণ হলো অনৈক্য। যদিও সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ইসলামের অন্যতম প্রধান আদর্শ, তা আজ মুসলিম দেশসমূহে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোগিতা, সৌহার্দ পূর্ণ সম্পর্ক এবং ঐক্যই কেবল এনে দিতে পারে সারা বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন।
অছি-এ-গাউসুল আ’যম ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিরপেক্ষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকের তাঁর কাছে অবাধ গমনের অনুমতি ছিল। তাঁর কাছে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম এরূপ কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকল প্রকারের চরিত্রবান লোককে তিনি আদর যত্ন করতেন এবং মনোযোগ সহকারে তাদের দুঃখের কথা শ্রবণ করতেন। তিনি ছিলেন দুর্গত মানবতার অকৃত্রিম সেবক। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নানুপুর, লেলাং প্রভৃতি ইউনিয়নের দুর্গত লোকদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেন। খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার দ্বারা তিনি অনেক দুর্গতকে নিজের প্রত্যক্ষ সেবায় সুস্থ করে তোলেন। অনেক অনাথ বালক-বালিকা ও ভবঘুরে তাঁর আস্তানায় লালিত পালিত হয়ে ও শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গরীব ও দুঃখী জনকে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। বাজারে যখন চড়াদামে দ্রব্য বিক্রয় হতো, তখন তিনি দরবার ষ্টোর থেকে ন্যায্য মূল্যে জনসাধারণের কাছে পণ্য বিক্রয়ের জন্য নির্দেশ দিতেন। আতিথেয়তায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। তাঁর অপূর্ব আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫৯ সালে মার্কিন কৃষি উপদেষ্টা রবার্ট ডব্লিউ ফাউলার (Robert W. Fawler) লিখেছেন, “I am extremely happy to have been a guest in this home of the religious leader and to view the activities of a great festival as is taking place. We are appreciative of your wonderful hospitality.”
অর্থাৎ ‘আমি একজন ধর্মগুরুর বাড়ীর অতিথি হয়ে এবং একটি মহান উৎসবের কর্মকান্ড দেখে অতিশয় খুশী। আমি আপনার অভূতপূর্ব আতিথেয়তায় কৃতজ্ঞ’।
মানবতার কল্যাণের ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউসুল আ’যমের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী শরাফতের মহান ধারক ও বিকাশধারী। সূর্য যেরূপ চিরভাস্বর, সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে আলো ছড়িয়ে দেয়, অছি-এ-গাউসুল আ’যমও সেরূপ স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সকল মানুষের কাছে মাইজভান্ডারী শরাফতের মহান শ্লোগান ‘মানবতার জয়গান’কে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
(ঞ) সমাজ সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক শরাফত (Social Organization or Institutional Structure)
সমাজকে সংগঠিত করা বা সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সৃষ্টি করা একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। মাইজভান্ডারী শরাফত তাই সমান সংগঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সমাজ গঠনের জন্য প্রধানতঃ তিনটি উপাদান প্রয়োজনঃ (১) একটি আদর্শ, (২) সে আদর্শভিত্তিক মজবুত সংগঠন এবং (৩) সে আদর্শ বাস্তবায়নের উপযোগী নেতৃত্ব। অছি-এ-গাউসুল আ’যম স্রষ্টার মহান ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সমাজের ঈপ্সিত সংস্কার সাধন করে গেছেন এবং মাইজভান্ডারী শরাফত সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিনির্মাণ করে গেছেন। মনগড়া, ভূয়া রীতিনীতি ও আচার পদ্ধতিতে কুসংস্কারাচ্ছন্
(ট) সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ড বা সামাজিক শরাফত (Social Welfare-Oriente
সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করা একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের ইহাও একটি বিশেষ দিক। সমাজ ব্যবস্থাকে অধিকতর সুন্দর করার মহান অভিপ্রায়ে যাঁরা জীবন বাজী রেখে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন অছি-এ-গাউসুল আ’যম তাদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি সমাজের জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহে
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শ্রীবৃদ্ধিকল্পে