——————–
“স্বামীর (বিশ্বঅলি শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী) বর্তমানে ও অবর্তমানে এই মহিয়সী মহিলা (শাহানশাহ্ মাইজভাণ্ডারীর ‘সম্মানিতা সহধর্মিণী’, উম্মুল আশেকিন আলহাজ্ব মুনাওয়ারা বেগম (রহ.) নিজ সন্তানদের লালন পালন, সুশিক্ষা ও পারিবারিক দায়িত্বের সাথে মনজিলের অভ্যন্তরীণ গুরু দায়িত্বও পালন করেন।
মেয়ে ভক্তদের দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা ধৈর্য সহকারে শুনে সমাধানের সুপরামর্শ দান, দরবারে আর্জি ফরিয়াদ ও দোয়া করেন। শাহানশাহ্ বাবাজানের পরশধন্য এই পূতঃ পবিত্র সেবিকা মনজিলে আগত বিপুলসংখ্যক মেয়ে পুরুষদের আদর আপ্যায়ন, থাকা খাওয়া, খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি হাসিমুখে সম্পন্ন করে মমতাময়ী মায়ের ভূমিকাই পালন করেন।
স্বামীর ওফাতের পর ভক্তদের মধ্যে ঐক্য রক্ষা, বিপুল ব্যয়ে রওজা শরিফ নির্মাণ, মনজিলের প্রচার-প্রসার ও উন্নয়নে তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও প্রায়োগিক কৌশল এক অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। সাংগঠনিক গুণ ও অনুপম চরিত্রে তিঁনি দরবারী মহলে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এ কন্যার মাধ্যমে (কন্যার) পিতার সেবার আর্জি বাসনা পরিপূর্ণ হয়েছে। আল্লাহ্ এ অনন্য পিতাকে জান্নাতবাসী করুন। হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র পবিত্র রক্তের ধারা এ পুণ্যবতী মহিলার মাধ্যমে মূর্ত হয়েছে। উত্তরসূরিদের মাঝে এই মা অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। মহান অলি-উল্লাহর সহধর্মিণী এই ভাগ্যবতী মহিলা পরবর্তীকালের লক্ষ কোটি মানুষের শ্রদ্ধাষ্পদ মা’জান; অগণিত ভক্তের প্রার্থিত শুভাশীষ।”
[সূত্র: “শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী”- গ্রন্থের ‘চরণ সেবায় উৎসর্গ’ শিরোনাম হতে]
আর আজ ২১ আশ্বিন, ৬ অক্টোবর মোতাবেক ২৯ সফরের এই রাতে ১০:০০ টার সময় অগণিত আশেক-ভক্তকে অপূরণীয় শূন্যতায় ভাসিয়ে দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের চির-সান্নিধ্যে চলে গেলেন এই মহীয়সী নারী। ‘গাউসিয়া হক মনজিল’-এর প্রতিষ্ঠার সময়সহ ‘দরবারে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী’র ইতিহাসে এই মহীয়সী নারীর অনবদ্য ভূমিকা লেখা থাকবে সোনালী ফলকে। একজন নারী মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কতটা রেয়াজত-সাধনা, কষ্ট স্বীকার করতে পারেন এর এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি এই মহীয়সী নারী।
বিশ্বঅলি শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র সাথে উম্মুল আশেকিন আলহাজ্ব মুনাওয়ারা বেগম (রা.)’র শাদি মোবারকের রয়েছে এক চমকপ্রদ প্রেক্ষাপট। প্রসঙ্গত তা নিচে উল্লেখ করা হলো, –
“(শাহানশাহ্ মাইজভাণ্ডারীর) ভাব বিভোরতা বাড়তেই থাকে। আত্মীয়-স্বজন পিতামাতাকে পরামর্শ দিলেন, বিবাহের উপযুক্ত বয়স; তাই বিয়ে করানোও প্রয়োজন। পিতা চিন্তা করলেন, এমন ছেলেকে কে আবার মেয়ে দেবে! তবু খোঁজ-খবর নেওয়া হল।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি মেয়ে দিতে প্রস্তাব দিলেন। সেখানে আত্মীয়তায় পরিবারের সকলে রাজি। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি নিজ মত পরিবর্তন করেন। এ’তে সকলে মনঃক্ষুণ্ণ হয়।
পরে ফটিকছড়ি থানার দাঁতমারা ইউনিয়নের প্রখ্যাত জমিদার জনাব বদরুজ্জামান সিকদার সাহেবের কনিষ্ঠা কন্যা মোসাম্মৎ মনোয়ারা বেগম সম্পর্কে আলোচনা হয়।
কিন্তু এক বৎসর পূর্বে সিকদার সাহেব একখানা চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, তাঁর একটা মেয়ে মাইজভাণ্ডার শরিফ বিয়ে দিলে হাশরের দিনে রাসূলুল্লাহ্ (দ.) তাঁর মুক্তির সুপারিশ করবেন। সে চিঠি তখনই দরবারে পাঠানো হয়েছিল। যোগাযোগের অসুবিধা ও অত্যধিক দূরত্বের জন্য প্রথমে সে চিঠির গুরুত্ব নিয়ে কেউ তেমন চিন্তা করেন নাই।
অবশেষে মৌং সৈয়দ মাহ্ফুজুল করিম সাহেবের প্রস্তাবে আলোচনা গতিলাভ করে। দৌলতপুর নিবাসী মেয়ের মামা আলতাপ মিয়া চৌধুরীকে সংবাদ দিয়ে আনা হয়। প্রাথমিক আলোচনা শেষে চৌধুরী সাহেব দিন-তারিখ ঠিক করে দাঁতমারা গেলেন, মৌং মাহ্ফুজুল করিম সাহেবও সঙ্গে যান। এ প্রস্তাব সিকদার সাহেব আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন। অলংকারপত্র ও কাবিননামার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলে সিকদার সাহেব বলেন, “মুনিবের দরবারে আমার মেয়েটা কবুল হলে অধীন চির-কৃতার্থ হই। আমার সেবা যেন চিরদিন অটুট থাকে। ভক্তের কিসের দাবী-দাওয়া।” কার্তিক মাসের পনের তারিখ রোববার শুভ-করার (নিশান) অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত হয়। এ আত্মীয়তার ব্যাপারে বরও সম্মত ছিলেন।
আরো পড়ুন-
http://alowkitaboalkhali.com/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9-%e0%a6%b9%e0%a6%95%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%a3%e0%a7%8d%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%b9/
সিকদার সাহেব হযরত দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর মুরিদ ছিলেন। হযরতের উরস্ শরিফে তিনি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দরবারে আসার সময় বিছানাপত্রসহ নিজ প্রয়োজনীয় সবকিছু তিনি সঙ্গে নিয়ে আসতেন এবং পূর্বের চাষ বাড়িতে থাকতেন। হজ্ব করে আসার পর তিনি স্বীয় বাড়ির পরিবর্তে মসজিদের পাশে একখানা পর্ণ-কুটিরে এবাদত বন্দেগীতে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। তিনি দৈনিক শুধু একবেলা আহার করতেন।
মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবে তিনি ভীষণ ভয় পান। নিজ পীর সাহেব যাকে তিনি আজীবন ‘বাবাজান’ ডেকেছেন, তাঁকে বেয়াই বানিয়ে একই চাদরে বসবেন এ যে অকল্পনীয়! তাই আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, “হে খোদা, আমাকে বাঁচাও; মুর্শিদকে বেয়াই জেনে আমি যেন দোজখী না হই।” তাঁর আবেদন বৃথা যায় নাই। শুভ-করার অনুষ্ঠানের চারদিন পূর্বে এগার কার্তিক, ১৯৫৪ সালের ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তারিখ ঠিক রাখার জন্য পুত্রদের নির্দেশ দিয়ে যান। শোক প্রশমনের জন্য দরবারের উপদেশ মতো এক সপ্তাহ পরে নিশান-পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের তারিখ ধার্য হয়: চৌদ্দ মাঘ; তেরশ বাষট্টি বাংলা, আটাশ জানুয়ারী: উনিশশ পঞ্চান সাল, মঙ্গলবার।
তাঁদের পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র:
সৈয়দা জেব-উন-নাহার বেগম, সৈয়দা হোমায়রা বেগম, সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান, সৈয়দা কুমকুম হাবিবা, সৈয়দা উম্মে মুনমুন হাবিবা, সৈয়দা নূরে আসমা কানিজ ফাতেমা। সকলের ভাল ঘর ও বরে বিয়ে হয়েছে। দাম্পত্য জীবনের চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়ে স্ত্রী নিজেকে মনেপ্রাণে স্বামী সেবায় নিয়োজিত করেন। বেদনার্ত মুহূর্তগুলো স্নেহময়ী শাশুড়ি গভীর মমতায় ভুলিয়ে দিতেন। শ্বশুরের কাছ থেকেও পেয়েছেন অত্যধিক স্নেহ। স্বামী জজ্‌বা হালে থাকলে ভীষণ রাগান্বিত হতেন। আবার শান্ত অবস্থায় সুমধুর ব্যবহারে হৃদয় আকুল করতেন, যা তুলনাহীন গভীর প্রেমময়। কষ্টকর কোন কাজ করতে এবং রান্না ঘরে যেতে নিষেধ করতেন। সব কাজ সেবিকাদের দিয়ে করাতে বলতেন। কখনো চা চাইলেন তো, সারারাত চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেদিকে খেয়ালই নাই। চোখে ঘুম নামলে কতো অসতর্ক মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়েও গেছেন। স্বামীর খেয়াল হলে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। এ বাড়িতে আসার পর একদা তাঁকে মূল ভবনে থাকতে নিষেধ করে পেছনের স্যাঁতসেঁতে নড়বড়ে বেড়ার ঘরে থাকতে বলেন। শীতকালে অত্যধিক ঠান্ডা বলে সেবিকা মেয়েদেরও সে ঘরে থাকতে দেওয়া হয় না। তবুও স্বামীর নির্দেশ পালন করেন। শত দুঃখ কষ্ট এভাবেই আশীর্বাদে পরিণত হয়। দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে এমনি অসংখ্য ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটেছে। [সূত্র: প্রাগুক্ত]
মোগাম্মদ আরমান হোসাইন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহিত
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here