মশার ধূপ: ফিরে দেখা ইতিহাস

মশা তাড়ানোর ধূপের ইতিহাসটা বেশ মজার। অতীতে প্রায় সব সভ্য দেশেই মশা তাড়ানোর কাজে নানান প্রাকৃতিক পদার্থের ধোঁয়া ব্যবহার করার চল ছিলো। সেই সূত্র ধরেই এসেছে আধুনিক মশার ধূপ।

আধুনিক মশা মারার বা মশা তাড়ানোর ধূপ প্রথম তৈরি হয় জাপানে, ১৯ শতকের শেষদিকে। তৈরি করেন এইচিরো উএয়ামা (上山英一郎) নামে এক তরুণ উদ্যোগপতি। তিনি প্রথম যে মশার ধূপ তৈরি করেছিলেন তাতে ছিলো কমলালেবুর খোসা গুঁড়ো, শ্বেতসার গুঁড়ো এবং পাইরেথ্রাম (Pyrethrum) নামক এক ধরণের প্রাকৃতিক পদার্থ। লম্বাটে গড়নের সেই ধূপটি প্রায় ৪০ মিনিট একনাগাড়ে জ্বলতো।

পরবর্তীতে এইচিরোর বুদ্ধমতী স্ত্রী ইউকি তাকে পরামর্শ দেন ধূপটিকে লম্বাটে না করে প্যাঁচালো (spiral) আকারে তৈরি করার, যাতে সেটি বেশিক্ষণ জ্বলে। এভাবেই আধুনিক মশা তাড়ানোর ধূপ বা মসকুউটো রিপেলেন্ট কয়েলের আবির্ভাব। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর মশা তাড়াতে এ ধরণের ধূপ বা কয়েলের ব্যবহার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এখন তো এগুলো সারা বিশ্বের বাজার ছেয়ে ফেলেছে। [Wikipedia]

মশা তাড়ানোর ধূপের উপাদান

আজকাল বাজারে যেসব মশা তাড়ানোর ধূপ বা কয়েল পাওয়া যায় সেগুলিতে থাকে মূলত নানারকম কীটনাশক ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। পাইরিথ্রিন জাতীয় কীটনাশকগুলির (Pyrethrins) কথা প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়। এছাড়াও মশার ধূপে থাকতে পারে

১) অ্যালেথ্রিন (Allethrin)

২) এসবায়োথ্রিন (Esbiothrin)

৩) মিপারফ্লুথ্রিন (Meperfluthrin)

৪) বিউটাইলেটেড হাইড্রক্সিটলুইন (Butylated hydroxytoluene, BHT)

৫) পাইপেরোনাইল বিউটক্সাইড (Piperonyl butoxide, PBO)

৬) এন-অক্টাইল বাইসাইক্লোহেপটিন ডাইকারবক্সিমাইড (N-Octyl bicycloheptene icarboximide, MGK 264)

৭) ডাইমেফ্লুথ্রিন (Dimefluthrin)

৮) মেটোফ্লুথ্রিন (Metofluthrin),

৯) পাইনামিন ফোর্ট (Pynamin forte)

১০) অক্টাক্লোরোডাইপ্রোপাইলইথার বা এস-২ (Octachlorodipropylether, S-2) ইত্যাদি।

এই উপাদানগুলি ছাড়াও এগুলিকে ধরে রাখার জন্য বাইন্ডার হিসেবে এবং ধূপের নিয়ন্ত্রিত দহনের জন্য জ্বালানি হিসেবে নানারকম পদার্থ মশা তাড়ানোর কয়েল বা ধূপগুলিতে ব্যবহার করা হয়।

মশা তাড়ানোর ধূপ: ভালো ও মন্দ

ধূপ বা কয়েলের ধোঁয়া মশা তাড়াতে কাজ ভালোই করে। বিশেষ করে আবদ্ধ জায়গাতে এগুলো বেশি কার্যকরী হয়। বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বেই মশার বাড়বাড়ন্ত ঘটছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকানগনিয়া ইত্যাদি মশাবাহিত রোগের তান্ডব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে আজকের পৃথিবীতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সব মশাবাহিত রোগে মারা যান [WHO]। এই অবস্থায় মশার হাত থেকে সপরিবারে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে মশা তাড়ানোর ধূপ ব্যবহার করলে ক্ষতি কি?

ক্ষতি আছে। এবং সেই ক্ষতির দিকগুলি বিবেচনা করলে মশার ধূপ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা ছাড়া উপায় থাকেনা। মশা তাড়ানোর কয়েল বা ধূপের ধোঁয়ায় থাকে নানান বিষাক্ত জৈব ও অজৈব বাষ্প এবং প্রচুর পরিমানে সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা (পার্টিকুলেট ম্যাটারস ২.৫)। এগুলো শুধু মশাদেরই তাড়ায় না, মারাত্মক ক্ষতি করে মানুষেরও। এক দিক থেকে হয়তো মানুষেরই ক্ষতি বেশি হয়। কারণ ধূপ জ্বাললে মশারা সাধারণত সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ ধূপ জ্বেলে নিজেরা সেই ধূপের বিষাক্ত ধোঁয়ার মধ্যেই বসে থাকে। সবথেকে বেশি ক্ষতি হয় শিশু ও কিশোর কিশোরীদের।

ধূপের ধোঁয়ায় বিষাক্ত বাষ্প

মশা তাড়ানোর ধূপ বা কয়েলগুলির দহনে তৈরি হয় অ্যালডিহাইড, ফরম্যালডিহাইড, বেনজিন, বেনজোপাইরিন, বেনজোফ্লিউরোঅ্যানথিন ইত্যাদি নানান বিষাক্ত উদ্বায়ী যৌগ। এগুলির অনেকগুলি মানুষের সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে পরিচিত। একটি মশার কয়েল প্রায় ৮ ঘন্টা জ্বলে। এরকম মশার কয়েল বা ধূপ জ্বেলে ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে থাকলে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ সহ ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। অধ্যয়নে দেখা গেছে, একটি মশার ধূপ জ্বাললে যে পরিমান ফরম্যালডিহাইড জাতীয় বিষাক্ত জৈব বাষ্প তৈরি হয়, তা প্রায় ৫০টা সিগারেট জ্বালানোর সমান।

সূক্ষ্মকণার বিপদ

শুধু বিষাক্ত জৈব বাষ্পই নয়, মশা তাড়ানোর ধূপ জ্বাললে আরো উৎপন্ন হয়, সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম ভাসমান কণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটারস। এই কণাগুলোর মাপ প্রায়শই থাকে ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম। এগুলো আমাদের নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসের একেবারে ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম কণাগুলো এমনকি রক্তেও মিশে যেতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এই কণাগুলোর প্রভাব মারাত্মক। এগুলো শুধু যে ফুসফুস, হার্ট, মস্তিষ্ক ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের ক্ষতি করে তাই নয়। দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে ক্যানসারের সম্ভবনাও বাড়িয়ে তোলে। অধ্যয়নে দেখা গেছে একটি মশা তাড়ানোর ধূপ জ্বাললে যে পরিমান সূক্ষ্ম কণা উৎপন্ন হয় তা প্রায় ১০০টা সিগারেট জ্বালানোর সমতুল্য।

দুর্ঘটনার আশঙ্কা

এগুলি ছাড়াও মশা তাড়ানোর কয়েল বা ধূপগুলির আর একটি বিপদের দিক হলো দুর্ঘটনার ভয়। প্রতি বছর জ্বলন্ত মশার ধূপ থেকে অসাবধানতা বশত বইখাতা, কাগজপত্র, জামাকাপড়ে আগুন লেগে যাওয়ার বেশ কিছু ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে বড়ো দুর্ঘটনা, এমনকি প্রাণহানিও ঘটে।

সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে

মশা তাড়ানোর ধূপ বা কয়েলগুলি স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ নয়। মশার হাত থেকে বাঁচতে চাইলে যান্ত্রিক পদ্ধতিই উত্তম। যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে পড়ে ঘরের দরজা জানালায় মশারোধী জাল লাগিয়ে নেওয়া, মশারি ব্যবহার, শরীর ঢাকা পোশাক পড়া, পায়ে মোজা পড়া, ইত্যাদি। সিট্রোনেলা, নিম, ইউক্যালিপটাসের মতো জৈব তেলও কিছু পরিমানে কাজে লাগানো যেতে পারে। দিনের মধ্যে যে সময় মশারা সবথেকে সক্রিয় থাকে, অর্থাৎ ভোরের বেলায় ও সন্ধে বেলায়, বেশি সতর্ক থাকতে হবে। নিজেরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে এবং ঘর ও ঘরের আশপাশ জমা জল মুক্ত রাখলে মশার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন পতঙ্গভুক প্রাণী, যেমন বাদুড়, ব্যাঙ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়েও পরিবেশে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here