মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: তালিজোড়া দিয়ে চলছে ৯০ বছরের পুরোনো জীর্ণশীর্ণ কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু। বর্তমানে সেতুটির অত্যন্ত করুণ দশা। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে শত শত যানবাহন। সরেজমিন দেখা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ-জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুর অবকাঠানো নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেতু পিচ, পিস প্লেট ও রেলবিট ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কয়েকস্থানে রেল লাইনের পাশের প্লেট ভেঙে গর্তের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মাঝখানের লাইনটি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেল লাইন ভেঙে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়াও সেতুর বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অন্তত ৩০টির মতো গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানি পড়লেই কংক্রিট ও পিচ ওঠে গর্তগুলো হাঁ করে থাকে। কালুরঘাট সেতুর টোল ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, কালুরঘাট সেতু দিয়ে দৈনিক চারটি যাত্রী ও একটি তেলবাহী ওয়াগন চলাচল করে। ছোট-বড় মিলে কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। ট্রেন ও বিভিন্ন যানবাহনে প্রতিদিন দেড় লক্ষাধিক মানুষ সেতু পারাপার হয়। জীর্ণশীর্ণ সেতু দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সেতু পারপার হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, সেতুর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে যাওয়ার পর সেতু পারাপার হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। রেলের ধসে যাওয়া ভাঙা লাইনে ধাক্কা খেয়ে ট্যাক্সি-টেম্পোর চাকা ও যন্ত্রাংশ প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়। সেতুর নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থার কারণে যানবাহন বিকল হয়ে প্রতিদিন যানজট লেগে রয়েছে। এতে মানুষের শত শত শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ‘৮০ দশকে সেতুর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। এরপর থেকে জোড়াতালি দিয়ে সেতুটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সেতুর অবস্থা নাজুক হয়ে যাওয়ায় ১০ টনের অধিক ওজনের ভারী যানবাহন পারাপার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রেলওয়ে। এই বিষয়ে সেতুর দুই পাশে দুটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সেরেছে রেল। বর্তমানে সেই সাইনবোর্ডের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু ১০ টনের অধিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও এর চার-পাঁচ গুণ ভারী ওজনের যানবাহন চলাচল করছে।
বোয়ালখালী পৌরসদর গোমদ-ী এলাকার জসিম উদ্দিন বাচা বলেন, জরাজীর্ণ ও একমুখী সেতুর যাঁতাকলে পড়ে প্রতিদিন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ-দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে বোয়ালখালীবাসীকে। যানজটে আটকা পড়ে অনেক প্রসূতি, রোগীবহনকারী এম্বুলেন্স পর্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শহরতলী উপজেলা হয়েও একটি সেতুর জন্য আটকে রয়েছে উন্নয়ন।
একটি সেতুর কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিশাল একটি জনপথ। এই সেতুটি বার বার রাজনৈতিক দলের ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর প্রধান অঙ্গীকার ছিল ‘কালুরঘাট সেতু’ নির্মাণ। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাসদের কার্যকরী সভাপতি মঈনউদ্দিন খান বাদল নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘একবছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে না পারলে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করবেন’। নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিকবার সেই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেছেন। সর্বশেষে গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে বলেছেন, কালুরঘাট সেতুর কাজ শুরু না করলে ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন। সাংসদ বাদলের এই হুঁশিয়ারি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম নাগরিক সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন কালুরঘাট সেতু নির্মাণের দাবি করেছে। আর বোয়ালখালীবাসী তো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে।
কালুরঘাট সেতু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাসের বাণী শুনে আসছেন চট্টগ্রামবাসী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কর্ণফুলী নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর (হযরত শাহ আমানত সেতু) উদ্বোধন শেষে পশ্চিম পটিয়ায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করার পর অনেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দ্রুত সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা জেগেছিল। কিন্তু কালুরঘাট সেতু নির্মাণ এখনো মূলা ঝুলানো প্রকল্পই রয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত কালুরঘাট সেতুর ওপর সেতু নির্মাণ বাস্তবায়ন চান বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী।
কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাটে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এই চুক্তির আওতায় কালুরঘাট সেতুর জন্য ছিল ১১৪৬ কোটি টাকা।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তির পর একাধিকবার সার্ভেও করা হয়েছিল। গত নির্বাচনের আগে কালুরঘাট সেতু প্রকল্প একনেক সভায় উপস্থাপনও করা হয়েছিল। অধিকতর সমীক্ষার জন্য প্রকল্পটি একনেক সভা থেকে ফেরত পাঠানো হয়।
সূত্র : দৈনিক পূর্বকোণ