মব (mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Justice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। মব জাস্টিস অনুৎসাহিত করতে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না।’
সাধারণভাবে বোঝায় জনতা আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে যখন তুলে নেন, তাই মব জাস্টিস। এ ধরণের ঘটনায় যদি কেউ মারা যায় বা জনতার গনপিটুনিতে কেউ মারা গেলে তাকে লিঞ্চিং (lynching) বলে। এর অর্থ বিচার বহির্ভূত হত্যা।
এছাড়া, জানতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মক জাস্টিসের অংশ।
আমাদের দেশে মব জাস্টিস এবং লিঞ্চিং প্রায়ই দেখে থাকি। ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে ‘ডাকাত’ সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল ৬ ছাত্রকে। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মা’কে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। সম্প্রতি এমন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর (২০২৪) যার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।
মব জাস্টিস ঘটার কারণ কী?
একটা দেশে, সমাজে মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিং বিভিন্ন কারণে দেখা দেয়। তবে আইনের শাসন না থাকা, দুর্বল আইন, বিচারের প্রতি জনতার অনস্থা সৃষ্টি হলে মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চং বেশি দেখা যায়। এছাড়া মানুষ যখন ক্রমাগত অন্যায়ে আর বিচারহীনতায় অতিষ্ট হয়ে উঠে তখনই ‘মব জাস্টিসে’র নামে ‘লিঞ্চিং মবে’র প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এ ধরণের বিচারে অনেক সময় সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আইনপ্রণয়নের অভাব: যদি জনগণ মনে করে যে আইন প্রণয়ন বা তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না, তখন তারা নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অব্যবস্থাপনা: প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা যদি দুর্বল বা অকার্যকর হয়, তখন মানুষ নিজের হাতে ব্যবস্থা নিতে পারে।
অসন্তোষ ও ক্ষোভ: যদি জনগণ নির্দিষ্ট একটি ঘটনায় গভীর ক্ষোভ বা অসন্তোষ অনুভব করে, তারা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মব জাস্টিসের আশ্রয় নিতে পারে।
সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনা: কখনও কখনও সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে জনগণ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে এবং নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে পারে।
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া: কিছু ক্ষেত্রে, অসন্তোষ বা ক্ষোভের কারণেই লোকেরা তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং মব জাস্টিসের দিকে চলে যায়।
রাজনৈতিক প্রভাব: রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, নিজেদের বা তাদের সমর্থকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।
অর্থনৈতিক প্রভাব: ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বিচার ব্যবস্থাকে কিনে নিতে পারে, নিজেদের অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে।
সামাজিক বৈষম্য: নিম্নবর্গের মানুষের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়া অনেক কঠিন হতে পারে, কারণ তাদের কাছে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করার মতো সামর্থ্য নাও থাকতে পারে।
বিচার বিভাগের দুর্বলতা: যদি বিচার বিভাগ দুর্বল হয়, তাহলে তা সহজেই রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপে নতি স্বীকার করতে পারে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা: যদি পুলিশ বা অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দুর্বল হয়, তাহলে তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না এবং মিথ্যা মামলা চালু করতে পারে।
দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন বলেছেন, ‘আইনি বিচার সকল নৈতিক কর্তব্যের সমষ্টি।’ বলা হয়, ‘আইনের নিয়মে পাওয়া ন্যায়বিচার সভ্য সমাজের স্থায়ী নীতি।’ বস্তুত, প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই নিজস্ব আইন রয়েছে। সে অনুযায়ী সব বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। আর এটার ব্যত্যয় ঘটলে বিচারকার্য বিঘ্নিত হয়, সৃষ্টি হয় অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা বা মব জাস্টিস।
মব জাস্টিস বন্ধ করতে করণীয়:
মব জাস্টিস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদেরকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণকে সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে এবং মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।