প্রণব বল
ঘরের শিশুটি অসুস্থ হলে বড়দের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। কোথায় নিয়ে যাবে, সঠিক চিকিৎসা কোথায় মিলবে, কী করবে ইত্যাদি চিন্তা পেয়ে বসে। তেমনি অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল মাদারবাড়ীর ইমন হোসেনকে। তাঁর একমাত্র সন্তান ফারহান জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর স্থানীয় চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নিয়ে যান বাসার তুলনামূলক কাছের দূরত্বের আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে।
চট্টগ্রাম শহরের একাংশের মানুষের কাছে শিশুদের চিকিৎসার জন্য নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে এই বেসরকারি হাসপাতালটি। আগ্রাবাদ, হালিশহর, বন্দর, পতেঙ্গা এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দাদের অনেকেই তাঁদের শিশুদের এখানে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। তবে বেসরকারি এ ধরনের হাসপাতাল ছাপিয়ে পুরো চট্টগ্রামের মানুষের কাছে শিশু চিকিৎসার জন্য এখনো প্রধান ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা পুরোটাই বিনা মূল্যে হয়। তাই প্রতিদিন রোগীও থাকে শয্যার চার গুণ।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেয়াদ তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের সব ধরনের চিকিৎসা এখানে হয়। আমাদের শয্যার তুলনায় আমরা কয়েক গুণ বেশি রোগীকে সেবা দিই। শিশুদের কিডনি, ক্যানসার, নবজাতক, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র সবই মেলে এখানে। সবকিছু বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। যেসব ওষুধ সরবরাহ নেই, সেটা শুধু কিনে নিতে হয়।’
চমেক হাসপাতালটি এখন ৩১৩১ শয্যার। কাগজে–কলমে এত শয্যার হলেও এখানে এখনো পর্যাপ্ত জনবল যেমন নেই, তেমনি নেই অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। তারপরও বিশাল জনগোষ্ঠীর সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালটি। এর মধ্যে শিশু চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে হাসপাতালটি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগী এখানে বেশি। চট্টগ্রাম ছাড়াও আশপাশের অন্তত ছয়টি জেলা থেকে প্রতিনিয়ত এখানে রোগী ভর্তি হয়।
চমেক হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের মোট শয্যাসংখ্যা এখন ৯০। এর বাইরে শিশুদের জন্য ১০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) শয্যা রয়েছে। কিন্তু রোগী কত থাকে, তা শুনলে অবাক হওয়ারই কথা। ৯০ শয্যার বিপরীতে রোগী থাকে গড়ে ৩৫০ জন। আর পিআইসিইউর জন্য লাইনে থাকে অন্তত ৩০ শিশু। এই হলো সরকারি হাসপাতালে শিশুদের চিকিৎসার হালচাল।
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জেবিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে শয্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রোগী থাকে। সরকারি হাসপাতালের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। এখানে চিকিৎসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে ওষুধও মেলে। তবে বেশি রোগী অনুযায়ী জনবল সেভাবে পাওয়া যায় না। তাই চিকিৎসক–নার্সদের হিমশিম খেতে হয়।’
গত শনিবার শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বাইরে কথা হয় মো. মনসুর নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি সাতকানিয়া থেকে তাঁর এক ভাইপোকে নিয়ে এখানে এসেছেন। মনসুর বলেন, ‘শিশুটির জ্বর। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধপত্র খাইয়েছি। কিন্তু জ্বর কমে না। একটু শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি।’
শুধু অন্তর্বিভাগে নয়, চমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগেও দিনে দুই থেকে প্রতিদিন হাজারখানেক রোগীর সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া একই হাসপাতালে রয়েছে শিশুদের টিকাদান কেন্দ্রও।’
কিডনি ও ক্যানসার চিকিৎসাও চমেকে: শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বাইরে রয়েছে শিশুদের নেফ্রোলজি বিভাগ। এখানে শিশুদের জন্য ১৫টি শয্যা বরাদ্দ রয়েছে। তবে রোগী থাকে প্রতিদিন ২০ জনের মতো। ২০১০ সাল থেকে বিভাগটি পুরোপুরি আলাদাভাবে করা হয়। এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য একটি ডায়ালাইজার। নবজাতক থেকে শুরু করে ১২ বছর বয়সী কিডনি রোগে আক্রান্ত শিশুদের এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
শিশু নেফ্রলোজি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক মারুফ উল কাদের বলেন, শিশুদের জন্য বিশেষায়িত কিডনি রোগের সেবা দেওয়া হয় এখানে। ১৫ শয্যার ওয়ার্ডটিতে নবজাতক থেকে শুরু করে ১২ বছরের শিশুদের কিডনি–সংক্রান্ত জটিলতার চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাইরে ডায়ালিসিস করাতে গেলে দু–তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে। এখানে অনেকটা বিনা মূল্যে তা করা যায়। কিডনি রোগের পাশাপাশি শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসাও মিলে চমেক হাসপাতালে। ২০১৩ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮ শয্যার শিশুদের অনকোলজি ও হেমাটোলজি বিভাগ। এর আগে শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে বিভাগটি ছিল। ১৮ শয্যার হলেও এখানে প্রতিদিন গড়ে একশ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকে। কেমোথেরাপি ও ডে কেয়ার সুবিধা রয়েছে এখানে। দিনে ভর্তি থাকে ১৫ জনের মতো ক্যানসার আক্রান্ত শিশু।
নবজাতকদের ভরসা : পৃথিবীর আলো দেখার পর অনেক নবজাতককে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। প্রি–ম্যাচিউর নবজাতকদের নানামুখী সমস্যা থাকে। এ জন্য দিনের পর দিন তাদের এনআইসিইউ (নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) দরকার হয়। এ জন্য নবজাতক কোনো ওয়ার্ডে তাদের রাখতে হয়। বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের রোগীকে সেবা দিতে দিনে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু চমেক হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে বিনা মূল্যে এসব রোগীর সেবা মিলে থাকে।
আগে নবজাতক ওয়ার্ডটি ছিল ৩২ শয্যার। এখন এই ওয়ার্ডটি করা হয়েছে ১২৪ শয্যার। এর মধ্যে ২৪টি ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) শয্যা। বাকিগুলো বিশেষায়িত নবজাতক চিকিৎসার শয্যা। কিন্তু ১২৪ শয্যার বিপরীতে এখানে রোগী থাকে ২০০ জনের বেশি।
নবজাতক ওয়ার্ডের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি। এসব রোগী খুবই স্পর্শকাতর। অনেক যত্নের ওপর রাখতে হয়। কিন্তু আমার জনবল সে অনুযায়ী নেই। চিকিৎসক ও নার্সের সংকট রয়েছে।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালে ওষুধপত্র বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। রোগীর খাবারও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে। জরুরি কিছু ওষুধ লাগলে তা বাইরে থেকে কিনতে হয়। অক্সিজেনের জন্য আলাদা টাকা লাগে না। এ ছাড়া পিআইসিইউতেও কোনো টাকা লাগে না। স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে এই সরকারি হাসপাতালে।
তবে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অভিযোগও নেহাত কম নয়। দালালের দৌরাত্ম্য, দারোয়ানের বকশিশ, ট্রলির জন্য টাকা, ডাকলে চিকিৎসক ও নার্স না পাওয়া, সরকারি ওষুধ সব সময় না মেলাসহ নানা অভিযোগ লেগেই থাকে। এসব অভিযোগের কিছু স্বীকারও করে কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত রোগী, জনবলের ঘাটতিসহ নানা কারণে এসব সমস্যা হয় বলে তাদের দাবি। চট্টগ্রামের আরেকটি সরকারি হাসপাতাল হচ্ছে আন্দরকিল্লার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল। ওখানেও সরকারি খরচে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে শিশুদের জন্য শয্যা রয়েছে ৫০টি। দিনে গড়ে এখানে ৩০ জন শিশু ভর্তি থাকে। এর বাইরে একই হাসপাতালের বহির্বিভাগে দিনে অন্তত ২০০ শিশু চিকিৎসা নিয়ে থাকে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা : বেসরকারি পর্যায়ে শিশুদের চিকিৎসাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালটির মোট শয্যা রয়েছে নয় শতাধিক। এর মধ্যে শিশুদের জন্য শয্যা রয়েছে ৩০০টি। শিশুদের আইসিইউ রয়েছে ১৯টি।
এ ছাড়া নবজাতকদের শয্যা ৬০টি। এখানে শয্যা পেতে হিমশিম খেতে হয়। বেসরকারি পরিচালনায় হলেও এই হাসপাতালটি চিকিৎসাসেবায় অনন্য। খরচও অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল অপেক্ষা তুলনামূলক কম।
হাসপাতালের পরিচালক মো. নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগীর চাপ খুব বেশি থাকে। আমাদের খরচ অনেক কম। শিশুদের আইসিইউ এবং নবজাতক শয্যার বিপরীতে আমরা ভর্তুকি দিয়ে থাকি।’
বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ হাসপাতালে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং ইমপেরিয়াল হাসপাতাল উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্তদের চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তবে এখানকার সেবায় একটি গ্রহণযোগ্য মান নিশ্চিত করে থাকে।
এই দুই হাসপাতালে নবজাতকদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। নবজাতক ওয়ার্ডে রোগীর ভিড়ও থাকে বেশি। খরচ বেশি হলেও এই হাসপাতাল দুটি নবজাতকের জন্য অনন্য। এর বাইরে নগরের পাঁচলাইশে পেডিকেয়ার হাসপাতালটি নবজাতকদের সেবা দিয়ে থাকে। এখানে খরচ তুলনামূলকভাবে কম। একইভাবে প্রবর্তক মোড় এলাকার বেবি কেয়ার হাসপাতাল নবজাতক ও শিশুদের জটিল রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকে।
বড় হাসপাতালের মধ্যে পার্কভিউ, সিএসসিআর, ম্যাক্স হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন, মেডিকেল সেন্টার, সার্জিস্কোপ হাসপাতালগুলোতেও শিশুদের বিশেষ চিকিৎসাসেবা রয়েছে।