সুশীল বড়ুয়া:
জন্মের পর থেকে স্বপ্ন দেখতেন বলেই কোন প্রতিকূলতা কোন বাধা তার চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। পরিবার সমাজ সংগঠন তার চলার পথে মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়ালেও তিনি সব প্রতিকূলতাকে জয় করে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। যাঁরা তার চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা শেষ পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করেছেন।
মঈনউদ্দিন খান বাদলের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিনের। বলতে গেলে আমরা ছিলাম গুরু শিষ্য। সম্পর্ক ছিল মান অভিমানের। তিনি আমাদের রাতের পর রাত রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন। মার্ক্স,এঙ্গেলস, লেনিন, চে গুয়েভারা, জুলিয়াস ফুসিক, দান্তে, ভলতেয়ার, বার্ট্রেন্ড রাসেল, পার্ল এস বার্ক, এম এন রায়, কমরেড মুজাফফর আহমদ থেকে সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ কোন কিছু বাদ ছিল না। বিংশ শতাব্দীর ষাট, সত্তর দশক সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রের ওয়েবে সারা বিশ্বের মেধাবী তরুণ যুবারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। তা থেকে এপার ওপার দুই বঙ্গের মেধাবী তরুণ যুবারা ও বাদ যায়নি। যখন তিনি রাজনৈতিক আলোচনা করতেন তখন আমাদের মনে হতো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অতি সন্নিকটে। তিনি যখন বার্মা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার ছাত্ররা বিশ্বের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর বক্তব্য উপস্থাপন করতেন মনে হত তিনি সেই সব আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছিল। তার যুক্তি, তথ্য উপাত্ত এত সমৃদ্ধ ছিলো যে আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে তার বক্তব্য শুনতাম।
তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য। একাত্তর সালে মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় সিরাজুল আলম খান তাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠান।এর কয়েক দিন পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি তখন চট্টগ্রাম পোর্টে অবস্থান রত সোয়াত জাহাজ থেকে গোলাবারুদ নামানো বন্ধ করার জন্য হাজার হাজার মুক্তি কামী জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজে আক্রমণের সময় তার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মৌলবী ছৈয়দ সহ চট্টগ্রাম মহানগরে অনেক গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তি যুদ্ধের পুরো সময় তিনি আগ্রাবাদ নওজোয়ান ক্লাবে অবস্থান করেন। নওজোয়ান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলো তার আত্মীয় । জালাল উদ্দীন, আলাউদ্দিন, জসিমউদদীন, আফতাব উদ্দীন সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে নতুন সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে তার ও নেতৃত্বে ছিলেন মঈন উদ্দিন খান বাদল। মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে তিনি জাসদ প্রতিষ্ঠার সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তখন তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর জাসদ গণবাহিনী গঠন করলে চট্টগ্রামে গণবাহিনীর কমান্ডার নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জাসদকে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি শুরু করার প্রক্রিয়ায় আনতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৬/৭৭ সালে জাসদ যখন কোন প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেনা তখন অধ্যক্ষ হারুনর রশীদের বোনের বিয়েতে বরযাত্রী বেশে নুরুল আলম জিকু সহ জাসদ নেতৃবৃন্দ মিরসরাই মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন প্রকাশ্য রাজনীতির। সেই সিদ্ধান্তের পর জাসদ ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। সেই প্রক্রিয়ার সাথে মঈন উদ্দিন খান বাদল ও জড়িত ছিল। জাসদ যখন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত তখন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাসদ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বাসদও ভাগ হয়ে যায় এবং তিনি আ ফ ম মাহাবুবুল হকের সাথে যুক্ত হয়ে খণ্ডিত বাসদের নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে আবারো তিনি জাসদের হাসানুল হক ইনু গ্রুপে যোগ দিয়ে জাসদের কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক দলে তার শেষ ঠিকানা হলো জাসদ শরীফ নুরুল আম্বিয়া গ্রুপে।
আম্বিয়ার সাথে মিলে তিনি এই জাসদ গঠনের নেতৃত্ব দেন। এবং এই গ্রুপের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। বাকশাল বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় সাত দল- পনর দল এবং পাঁচ দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গঠনে তার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনজোটের রূপরেখা প্রণয়নের তিনি অন্যতম রূপকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রধান বিচারপতির নাম প্রথম তিনি প্রস্তাব করেন। চৌদ্দ দলীয় জোট গঠনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নিবার্চনে চৌদ্দ দলীয় জোট থেকে বোয়ালখালী চান্দগাঁও চট্টগ্রাম -৮ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ সংসদে দেখতে পেল এক নতুন পার্লামেন্টারিয়ানের রূপ। যাঁর মধ্যে ছিল গভীর প্রজ্ঞা, যুক্তি, তথ্য উপাত্ত দিয়ে বক্তব্য প্রধান অন্য কোন পার্লামেন্টারিয়ানের মধ্যে আগে দেখেনি দেশের গণতন্ত্র কামী জনতা। যার ক্ষুরধার যুক্তি পূর্ণ বক্তব্য সবসময় ট্রেজারি বেঞ্চ ও বিরোধী দলকে তটস্থ রাখতো। পর পর তিনবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কি সংসদে বা কি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টকশোতে তার সঙ্গে কোন ব্যক্তি তার যুক্তি তথ্য উপাত্তকে সহজে খন্ডন করতে পারতো না। তারমতো বাংলাদেশের আইন, সংবিধান, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে তার জ্ঞান অধ্যয়ন দেশের রাজনীতি বিদদের মধ্যে খুব কম পাওয়া যাবে। আমার জানা মতে তিনিই প্রথম বাংলাদেশি রাজনৈতিক হিসেবে বৃটিশ কমন্সসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তখন তিনি সংসদ সদস্য ও নির্বাচিত হননি।
সংসদে তিনি চট্টগ্রামের স্বার্থ নিয়ে সবসময় বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। যা চট্টগ্রামের অন্য কোন সংসদ সদস্য কথা বলতেন না। বোয়ালখালীকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি বিদেশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে চলেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে আইটি ভিলেজ প্রতিষ্ঠা, কর্ণফুলী তীর ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ প্রতিষ্ঠা করে পর্যটনের স্থান প্রতিষ্ঠা, মেধসমুনি আশ্রমকে হিন্দুদের আন্তর্জাতিক তীর্থস্থান হিসেবে রূপ দেওয়া। মেধসমুনি তীর্থ স্থান নিয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে তিনি প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।
বোয়ালখালীকে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নয়নের ভিলেজ হিসেবে উন্নীত করার জন্য তিনি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তার অন্যতম স্বপ্ন ছিল কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করা। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু না করলে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের।এই সেতু তিনি দেখে যেতে পারেনি। কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতুর মঈনউদ্দিন খান বাদলের স্পষ্ট পদত্যাগের ঘোষণার কথা স্মরণ করে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এক টিভি টকশোতে কালুরঘাট সেতুর জন্য মঈন উদ্দিন খান বাদলকে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মঈন উদ্দিন খান বাদলের সামাজিক রাজনৈতিক জীবন কখনোই মসৃণ ছিল না। তাঁর পরিবার ছিলো খুবই রক্ষণশীল। পরিবারের সমস্ত রক্ষণশীলতা উপেক্ষা করে সে প্রগতিশীল চিন্তার দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পথ চলা ছিল আরো কঠিন। কি চট্টগ্রাম বা কি কেন্দ্রে তাকে কেউ এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ছাড় দেয় নি। সমস্ত প্রতিকূলতাকে তিনি জয় করেছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশের পার্লামেন্টারি রাজনীতির ইতিহাস দেখলে দেখা যায় মঈনউদ্দিন খান বাদলের মতো এতো প্রজ্ঞাবান যুক্তি বাদী তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান ছিলোনা বললেই চলে।পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি দেশ- বিদেশে যে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা বিরল।স্বল্প সময়ের পার্লামেন্টারি ইতিহাসে তিনি যে দক্ষতা অর্জন করেছিল তা ছিল সত্যিই অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ তার এক বীর কে হারালো আর চট্টগ্রাম হারালো তার এক অকৃত্রিম চট্টল প্রেমিককে।
মঈন উদ্দিন খান বাদল ছিলেন রাজনীতির এক স্বপ্ন বিলাসী কবি। তিনি নিজে যেমন স্বপ্ন দেখতেন তেমনি মুক্তি কামী জনতাকেও স্বপ্ন দেখাতে ভালো ভাসতেন। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা তাকে কোনদিন ভুলবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।