অমর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মার্ক টোয়েনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। একবার তিনি বলেছিলেন- প্রতিদিন দুটি সূর্য ওঠে আকাশে। একটি আকাশের সূর্য, আরেকটি সমাজের। সমাজের সূর্য বলতে তিনি সংবাদপত্রকেই বুঝিয়েছিলেন। আসলে সূর্য যেমন, সাংবাদিকতা পেশাটাও তেমন- একদিনের জন্যও বিরতি নেওয়ার অবকাশ নেই। করোনার এই সময়ে যুদ্ধ করেই আমরা প্রতিদিনের সূর্যোদয় অব্যাহত রেখেছি। সূর্য না উঠলে যে সকাল হয় না। আমাদের চাই প্রতিদিন নতুন নতুন সম্ভাবনার সকাল।
বলা হয়ে থাকে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শেষ সৈনিকটিও পালাতে পারে। কিন্তু তখনও সাংবাদিককে থাকতে হয় সেই পলায়নের খবর অন্যদের জানাতে। তাই অবকাশ যাপনে গিয়েও আমাদের চোখ-কান খোলা থাকে। পশ্চিমা প্রবাদে বলা হয়, সায়েন্স নেভার স্লিপস। বিজ্ঞান কখনও ঘুমায় না। একই কথা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য। ঘুমায় না শুধু নয়, সংবাদমাধ্যম ঘুমানোর কথা চিন্তাও করে না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও আমরা জাগ্রত এবং সক্রিয়। প্রায় সবাই যখন ঘরবন্দি, আমরা তখনও সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে ছুটে বেড়াচ্ছি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ঘটনাবলি যখন সাধারণ নাগরিক কিংবা অন্যান্য পেশার জন্য সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দেখা-শোনা, আলোচনা-সমালোচনার বিষয়, সংবাদমাধ্যমের জন্য তখন তা ‘ইভেন্ট’ মাত্র। সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে নিয়োজিত সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের কাছে ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি কীভাবে তুচ্ছ হয়ে যায়, তার উদাহরণ অনেকবারই দেখা গেছে। মনে পড়ে, ২০১৭ সালের এই এপ্রিল মাসেই ভারতের এক টিভি চ্যানেলের নিউজ প্রেজেন্টার সুপ্রীত কাউরকে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পাঠ করতে হয়েছিল নিস্কম্পকণ্ঠে। মনে আছে, ২০১৫ সালে ঢাকায় যখন ভূমিকম্প হচ্ছিল, তখনও লাইভ টকশোগুলোতে হোস্টরা অনুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেও পেশার প্রতি এই অঙ্গীকার আর কোথায় দেখা যায়?
সমকাল পরিবার এখন এক বিশেষ সময় অতিবাহিত করছে। সম্পাদকীয়, ফিচার, ক্রীড়া, বাণিজ্যসহ কয়েকটি পাতা তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে ‘হোম অফিস’ থেকে। বস্তুত দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তারের শুরু থেকেই অফিসের বাইরে ও ভেতরে আমরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। সব ক্ষেত্রেই যাতে সীমিত জনবল দিয়ে সর্বোচ্চ কাজ করা যায়, সেই চেষ্টা করে এসেছি। একই সঙ্গে আমরা আমাদের অন্যান্য সামাজিক অঙ্গীকার পালনেও সচেষ্ট রয়েছি। দুর্গতদের পাশে দাঁড়াচ্ছি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে, ঝুঁকিপূর্ণ পেশাজীবীদের দিচ্ছি পিপিই। সুহৃদ চিকিৎসকদের সহযোগিতায় অনলাইনে চিকিৎসা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছি। সর্বশেষ মাত্র ত্রিশজন সহকর্মী নিয়ে গত ২৪ এপ্রিল শুক্রবার থেকে আমরা সমকালের প্রধান কার্যালয়েই সার্বক্ষণিক অবস্থান নিয়েছি। এই দলে একেবারে অফিস সহকারী থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত রয়েছেন। নিউজ ম্যানেজমেন্ট, রিপোর্টিং, নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন, গ্রাফিক্স এবং সম্পাদনা সহকারী বিভাগের নির্বাচিত কর্মীরা সার্বক্ষণিক অফিসে থেকে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। সমকালের প্রধান কার্যালয়কে কার্যত ‘লকডাউন’ করে আমরা কাজ করছি, খাচ্ছি এবং ফ্লোরে ঘুমাচ্ছিও। পবিত্র রমজান মাসে কাজটি অনেক কষ্টের, তারপরও সহকর্মীরা হাসিমুখে এটা করে যাচ্ছেন বৃহত্তর স্বার্থেই। এর আগে সমকাল শুধু নয়, দেশের আর কোনো সংবাদপত্রের কর্মীদের এভাবে অফিসেই দিনের পর দিন অবস্থান করতে হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অনেক চিন্তাভাবনা করেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা কেউ বাইরে যাচ্ছি না, বাইরের কারও সংস্পর্শে আসছি না। এতে আমাদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের পরিবার- পরিজনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়েছে। আর একই সঙ্গে নিশ্চিত হয়েছে সমকালের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা। আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সমকাল যে পদ্ধতি অনুসরণ করছে, অফিস চালনার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। সংকট পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এক মাস পর প্রথম টিম বাসায় যাবে, আসবে দ্বিতীয় টিম, তারপর তৃতীয়। আর একই সঙ্গে অফিসের বাইরে যেসব সহকর্মী রয়েছেন, তারাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকছেন অনলাইন এবং ডিজিটাল নানা মাধ্যম ব্যবহার করে। মূলত আমরা সবাই-ই আছি কাজের মধ্যে- কেউ অফিসে, কেউ ঘরে।
অফিসে সার্বক্ষণিক উপস্থিতির মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ না হোক; করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র বা বৃহত্তর অর্থে সংবাদমাধ্যমকে সার্বিকভাবে যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে, তা নজিরবিহীন হলেও নতুন কি? আমরা প্রতিদিনই এক একটি নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হই, প্রতিদিনই আমাদের জন্য এক একটি পরীক্ষা। বিশ্বব্যাপীই রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ- যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের প্রতিমুহূর্তের খবর তুলে আনতে কাজ করে যেতে হয়। যুদ্ধ, সংগ্রাম, বাস্তুচ্যুতি, নির্বাচন, সমঝোতা, অস্ত্রবিরতি, পরমাণু প্রতিযোগিতা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল, জলবায়ু পরিবর্তন, জীবজগৎ, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, আবিস্কার, পুরস্কার- সবকিছুই আমাদের থাকতে হয় আক্ষরিক অর্থেই নখদর্পণে। তার মানে এই নয় যে, সাংবাদিকরা নিছক তথ্যযন্ত্র। তারাও রক্তমাংসের মানুষ। আমরা কাজ করে চলেছি মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের নানা আবেগকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে। আমরা যে করোনা মোকাবিলায় ‘ফ্রন্টলাইনের’ যোদ্ধা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দেশে ও বিদেশে একই চিত্র দেখছি। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনের ক্রিস কুমো করোনা আক্রান্ত হয়েও যেভাবে তার নিয়মিত টকশো হোস্ট করে গেছেন, তা অনেকের জন্য অনুসরণীয়। গত ৩১ মার্চ করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নিউইয়র্কে নিজের বাড়ির বেজমেন্ট থেকে অনলাইনে টকশো হোস্ট করেছেন। পরের সপ্তাহে তার স্ত্রী, তার পরের সপ্তাহে একমাত্র পুত্র করোনা পজিটিভ হয়েছে; কিন্তু ক্রিস কুমো তার শো চালিয়ে গেছেন। এভাবে আরও অনেক সাংবাদিক এই করোনা পরিস্থিতিতে জীবন বাজি রেখে তথ্যসেবা দিয়ে চলছেন। আমরা হয়তো সবার খবর জানি না। সিএনএনের মতো বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের হোস্ট বলে কুমো নিজেই সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। আমাদের দেশেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত সাংবাদিক হয়তো করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে নূ্যনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া সংবাদ সংগ্রহের স্বার্থে দিন-রাত কাজ করে চলছেন, কয়জনের নাম জানি আমরা? তবে আমরা এতটুকু জানি- সাংবাদিকতা নিছক একটি পেশা নয়, বরং এটি লাইফস্টাইলের নামান্তর। আমাদের অনেকের কাছে জীবন ও সাংবাদিকতা সমার্থক। তাইতো আমরা যেকোনো ঝুঁকি নিতে পারি।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে যুদ্ধ, দুর্যোগ, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাই যদি বলি, প্রায় প্রতি দশকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক জরুরি পরিস্থিতি পার করেছে এই দেশের সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম। চল্লিশের দশকের দেশভাগ, পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, সত্তর দশকের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের দশকে ভোটাধিকারের আন্দোলন, একুশ শতকের প্রথম দশকে জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় দশকে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের আন্দোলন- সংবাদপত্র সবসময়ই জনগণের পক্ষে থেকেছে। শান্তি, সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে, প্রতিটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সংবাদমাধ্যম নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। নিজের ভেতরের রক্তক্ষরণ মেনে নিয়েই আমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষা করে গেছি।
পশ্চিমা দেশগুলোতে দশক কেবল নয়, শতকের পর শতক যে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, তা সংবাদমাধ্যমের স্থিতিশীলতায়ও ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশে যেমন রাজনৈতিক, তেমনই শাসনতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। স্বাধীনতার পরপরই যেখানে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা সবচেয়ে জরুরি ছিল, তখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যকাণ্ড ঘটে। দেশ ফিরে যায় পেছনের দিকে। পরবর্তীকালে দশকের পর দশক আমরা সামরিক শাসন দেখেছি, আধা সামরিক শাসন দেখেছি, অনির্বাচিত সরকারের শাসন দেখেছি। শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা এসেছে, আমরা দেখছি সংবাদমাধ্যমেরও মৌলিক বিষয়গুলো এখন আলোচনায় উঠে আসছে।
কেবল রাজনৈতিক সংকট নয়, দশকে দশকে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগও যেন বাংলাদেশের নিয়তি। প্রায় প্রতি দশকে বাংলাদেশকে অন্তত একটি প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বড় ঘূর্ণিঝড়ের পরম্পরা বা ফ্রিকোয়েন্সি এখন আরও বেড়েছে। কয়েক বছর পরপরই বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে আমাদের উপকূলে। আগাম বন্যা এসে খেয়ে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের ধান। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে নদীভাঙন। স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমকে এসব দুর্যোগ স্পর্শ করে। কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, সেসব দুর্যোগ নিয়েই সময়োচিত সংবাদ ও উপযুক্ত বিশ্নেষণ বরাবর তুলে ধরে এসেছি। নিজেদের শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এদেশের সংবাদমাধ্যম দায়িত্ব পালনে, দায়িত্বশীল আচরণে কখনও পিছপা হয়নি।
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে ২০০৫ সালে যখন আত্মপ্রকাশ করেছিল সমকাল, তখনও বাংলাদেশে ছিল এক টালমাটাল সময়। আমাদের মনে আছে, তার কিছুদিনের মধ্যেই দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল জেএমবি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অঞ্চলজুড়ে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব ‘শাসন ব্যবস্থা’। সঙ্গে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসেছিল বহুল আলোচিত ‘ওয়ান ইলেভেন’। ওদিকে ২০০৭ সালেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল। মাত্র এক বছর পর ২০০৯ সালে এসেছিল আরেকটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, আইলা। জঙ্গিবাদ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই সমকাল এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে আমরা দেড় দশক পার করেছি। কিন্তু আগে কখনও এভাবে কিছু সহকর্মীকে ‘হোম অফিস’ করতে দিয়ে কিছু সহকর্মীকে নিয়ে অফিসকেই হোম বানানোর প্রয়োজন হয়নি।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যেমন বিশ্ববাসীর জন্য, তেমনই সমকালসহ দেশ ও বিদেশের সংবাদমাধ্যমের জন্যও এক নতুন বাস্তবতা। আগের জরুরি পরিস্থিতিগুলো ছিল এক বা দুই দিনের, বড়জোর এক সপ্তাহের জন্য। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো। যত বড় আঘাতই হোক না কেন, মানুষ বাইরে বের হতো। এবার আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস ঘরে থেকেও কবে বের হতে পারব, সেই নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আগের দুর্যোগগুলোতে প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালীই হোক, তা ছিল দৃশ্যমান। এবার আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্যমান এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। যেকোনো দুর্যোগেই বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, আর এবারের লড়াইয়ের মূল কৌশলই একে অন্যের থেকে দূরে থাকা। যদিও এটা মানসিক নয়, শারীরিক। এই দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা মানসিকভাবে আরও কাছাকাছি থাকব। তৈরি করব অভিন্ন হৃদয়বন্ধন। লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। আমরা জানি মানুষের জয় সব সময়ই অবশ্যম্ভাবী।
বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ তত্ত্ব আমরা গত কয়েক দশক ধরে ক্রমেই বাস্তব হয়ে উঠতে দেখছিলাম। এর ইতিবাচক দিক নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো সেই বিশ্বগ্রামের নেতিবাচক দিকও সামনে এলো। আগে যেসব ভাইরাস বা সংক্রমণ একটি অঞ্চলে বা বড়জোর একটি দেশে সীমিত থাকত, গেল্গাবাল কানেকটিভিটির কারণে এবার তা ছড়িয়ে গেল গোটা বিশ্বে। সংবাদমাধ্যমের দিক থেকে দেখলে অবশ্য করোনা সতর্কতাও আমরা স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি বৈশ্বিক মাত্রায়। এখন আমাদের লড়াই ও ঘুরে দাঁড়ানোও কি বৈশ্বিক মাত্রায় হতে পারে না?
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বৈশ্বিকভাবেই যেসব শিল্প সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, সংবাদমাধ্যম তার একটি। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে এই চ্যালেঞ্জ আরও বড়। ইতোমধ্যে আমরা দেখছি, দেশে অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে মারাও গেছেন একজন। আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র আমরা এখনও জানি না। কিছু সংবাদপত্র মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। একই পরিস্থিতি বৈশ্বিক পর্যায়েও। এই দুঃসময়ে আমাদের যেমন ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, তেমনই থাকতে হবে সতর্ক ও জাগ্রত। বৈশ্বিক পর্যায়ে সংবাদমাধ্যম কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে, সেখান থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি।
এক্ষেত্রে সরকারের উচিত সংবাদমাধ্যমের পাশে দাঁড়ানো। মনে রাখতে হবে, সংকটকালে তথ্যসেবা দিয়ে সবার পাশে থেকেছে সংবাদমাধ্যম। অন্যথায় গুজব ও ফেইক নিউজের তোড়ে করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। মানুষের মধ্যে গুজব থেকে তৈরি হতে পারত আতঙ্কজনক ও সহিংস পরিস্থিতি। আমরা মনে করি না, করোনা পরিস্থিতি সহসা পরিণতি পাবে। আরও অনেক দিন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সক্রিয় ও সতর্ক থাকতে হবে। এই লড়াইয়ে সংবাদমাধ্যমের পাশে থাকতে হবে অন্য পেশাজীবী, রাজনীতিক ও সরকারকে। সর্বোপরি নাগরিকদের। নাগরিকদের সমর্থন ও ভালোবাসাই আমাদের শক্তি ও সাহসের উৎস। আমরা জানি, বাঙালির রয়েছে বিপদ জয় করবার বহুমাত্রিক ইতিহাস। আমাদের সম্মিলিত ও উজ্জীবিত প্রাণের স্পর্শে আশঙ্কার কালো রাত কেটে যাবে। আমরা আবার সরব হবো নগরে ও গ্রামে।
একটি কথা মনে রাখতেই হবে, সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম মানে নিরন্তর সংগ্রাম। এই যুদ্ধের শেষ নেই, শেষ থাকে না। আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে চাই। হোম অফিস কিংবা অফিস হোম- অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে সমকাল প্রকাশ হয়েই চলবে। এই লড়াইয়ে সবাই আমরা একাট্টা। সমকালের সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক-কর্মচারী, লেখক, পাঠক, হকার, বিজ্ঞাপনদাতা- সবাই মিলেই আমরা এই দুঃসময় পাড়ি দেব। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে’। করোনাভাইরাস মহামারির এই সময় সাগরও আমরা পাড়ি দেব। আমাদের অবশ্যই দেখা হবে সব অমানিশা শেষে সম্ভাবনার নতুন সূর্যোদয়ে, নতুন সকালে।
দৈনিক সমকাল: ২০-৪-২০২০