অনলাইন প্রতিবেদক
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হওয়ায় কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কারখানাগুলো বন্ধ হতে চলেছে। দীর্ঘ চার দশক ধরে উদ্যোক্তা, শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের শ্রমে-ঘামে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।
অর্থনীতিবিদ এবং ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, কারখানাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষ বেকার হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবেন। সরকার চাইলে এ লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যকর ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে পারে। বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা অর্থ আদায়ের পথ খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে শিল্পগোষ্ঠীটির শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন, এই কল-কারখানাগুলো খোলা রাখার ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে কোম্পানির কাছে পাওনা সব অর্থ আদায়ও সম্ভব হবে বলে মনে করেন নীতিনির্ধারকরা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতের সংস্কারে মনোযোগ দেয়। আর্থিক খাতে সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। নানা অভিযোগে সেই সঙ্গে ফ্রিজ করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টও। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের পর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা ও এলসি খোলার মতো নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রুপটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে। নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে না পেরে বাধ্য হয়েই কর্মী ছাঁটাই করছে গ্রুপটি।
এ বিষয়ে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘গ্রুপটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ নিয়ে রেখেছে, তা কীভাবে ফেরত পাওয়া যায়, সেই প্রক্রিয়া চলমান রেখেই এর কল-কারখানাগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত কারখানাগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি অব্যাহত থাকবে, মানুষের কর্মসংস্থান রক্ষা পাবে। দেরি হলে মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। বেশি বিপদে পড়বেন ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের পরিবারগুলো।
নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে এস আলম গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে। চাকরি হারানোর ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে তারা জানান, সরকার চাইলে কোম্পানিগুলো চালু রাখতে পারে। রক্ষা পেতে পারে শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি। কারখানা বন্ধ রেখে মালিকপক্ষ খুব বেশি দিন বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারবে না। কাঁচামাল আমদানি করার সুযোগ পেলে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক গতিতে উৎপাদনে ফিরতে পারবে। উৎপাদন অব্যাহত থাকলে কিস্তি পরিশোধ করার সুযোগ থাকবে। না হলে একে একে সব কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে সবাই বেকার হবেন। এ বিষয়ে মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে এস আলম গ্রুপ। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গ্রুপটির ব্যাপক অবদান রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিত রাজস্ব দিয়ে আসছে গ্রুপটি। চলতি বছরেই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
গ্রুপটির রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প, টেক্সটাইল, ভোগ্যপণ্য, ঢেউটিন, পরিবহন, সিমেন্ট, ইস্পাত, হ্যাচারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন।
দেশের বিদ্যুৎ খাতেও গ্রুপটির বিপুল বিনিয়োগ আছে। বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারায় ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রায় সিংহভাগ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হয়।
প্রতিবছর তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই শিল্পগ্রুপটি।
এস আলম গ্রুপের অধীনে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, দাতব্য সংস্থা ও এতিমখানা পরিচালিত হচ্ছে। তা ছাড়া ২০২০ সালে করোনার সময় এই গ্রুপটি অসংখ্য হাসপাতালে অর্থ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। হাজার হাজার অসহায় পরিবারের কাছে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে শুকনো খাবার। দেশের যেকোনো দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায় এস আলম গ্রুপ।
ছাড়া গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। দেশের সরবরাহ চেইন ঠিক রাখার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গ্রুপটির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এলসি সুবিধা বন্ধ ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার কারণে তাদের পক্ষে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহল মনে করে, হঠাৎ করে এ রকম অবদান রাখা একটি গ্রুপের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। এতে চাহিদা অনুযায়ী জোগানের ঘাটতি তৈরি হবে এবং দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই তাদের অভিমত, প্রয়োজনে ব্যাংকের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পণ্য আমদানি, উৎপাদন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা সরাসরি ব্যাংক কর্তৃক সংগ্রহ করে এলসির দায় পরিশোধ করে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আগের দায় সমন্বয় করা যেতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাবে এবং শিল্পগুলো রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক-কর্মচারীরা বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
এস আলম গ্রুপের চিনির মিলের ডিজিএম প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৩১ অক্টোবর থেকে সুগার মিল বন্ধ। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করায় কাঁচামাল কেনা যাচ্ছে না। তাই মিল বন্ধ রাখা হয়েছে।’
গ্রুপের তেল মিলের জিএম প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামও একই সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘কাঁচামালের অভাবে প্রায় দুই মাস ধরে তেলের মিল বন্ধ রয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ থাকায় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না।’ এই কারখানার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘কারখানা বন্ধ থাকলে কোম্পানি বেতন দেবে কোত্থেকে? কারখানাগুলো চালু রাখার ব্যাপারে সরকারের উচিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।’
© খবরের কাগজ
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here