ফিরে দেখা
নিউইয়র্কের অভিজাত জ্যামাইকা অঞ্চলে একটি পথের নাম শ্রীচিন্ময় স্ট্রিট। একজন বাঙালি সাধককে সম্মানিত করার জন্যই তাঁর জীবদ্দশায় এই নামকরণ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, নরওয়ের অসলোতে মানুষটির একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি আছে। জাতিসংঘে রয়েছে তাঁর নামে স্থায়ী প্রার্থনাকক্ষ।
বিশ্বজোড়া তাঁর অসংখ্য ভক্ত অনুসারী। নিজের কর্মে, সাধনায় বিশ্বব্যাপী এক বিশাল মনোরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এ এক অভূতপূর্ব বিশ্বজয়। এই জয়ের নায়ক চিন্ময় ঘোষ। তিনি বাংলাদেশের সন্তান। জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ আগস্ট চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার প্রত্যন্ত গ্রাম শাকপুরায়।

অচেনা শ্রীচিন্ময়:

পশ্চিমবঙ্গের লেখক শংকর অচেনা শ্রীচিন্ময় নামে একটি বই লিখেছেন তাঁকে নিয়ে। ১৯৮৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় এক বন্ধুর সঙ্গে ইউএন ভবনে ঘুরতে যান। সেখানে তিনি অধিকাংশ মহিলার পরনে শাড়ি দেখে বিস্মিত হন। শ্বেতাঙ্গিনী, কৃষ্ণাঙ্গিনী, চীনা, জাপানি সব রকমের
শাড়ি পরিহিতা মহিলাই তাঁর নজরে পড়ল। তখন ইউনিসেফে কর্মরত এক
বাংলাদেশি তাঁকে জানালেন, ‘পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশের শত শত মহিলাকে এখানে শাড়ি পরতে দেখবেন। শাড়ির নমনীয়তা ও সহজাত সৌন্দর্য এঁদের আকৃষ্ট করেছে ভেবে ভুল করবেন না। এর পেছনে রয়েছেন একজনই— তিনি শ্রীচিন্ময়কুমার ঘোষ।’ বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। এসব মহিলা নাকি শুধু শাড়িই পরেন না, এঁরা সবাই বাংলা গান জানেন। লেখক শংকর দেখলেন ইউএন ভবনের মেডিটেশন সেন্টারে ভক্ত পরিবেষ্টিত চিন্ময়কে। তাঁর কাছ
থেকে দীক্ষা নিতে জাতি– বর্ণনির্বিশেষের জাতিসংঘের ছোট-বড়
কর্মকর্তারা সেখানে সপ্তাহে দুদিন জড়ো হন। সেই দীক্ষা তাঁদের জীবনাচরণ পাল্টে দিয়েছে। আমেরিকায় থেকেও তাদের মন পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে। এমনকি তাঁদের অনেকেই নিজেদের পশ্চিমা নাম বাদ দিয়ে চিন্ময়ের দেওয়া বাংলা নাম নিয়েছেন। শুধু ইউএন ভবনে নয়, পৃথিবীজুড়ে তিনি এক অধ্যাত্ম আন্দোলনের নেতৃত্বৃ দিয়েছেন। যিনি হার্ভার্ড, ইয়েল, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো শত শত
বিশ্ববিদ্যালয় চষে বেড়িয়েছেন। কখনো নিউইয়র্কে, কখনো ওয়াশিংটনে অথবা লন্ডন, প্যারিস কিংবা স্টকহোমে চলে গেছেন। জাপান, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এমনকি আফ্রিকার জাম্বিয়াতেও স্থাপন করেছেন মেডিটেশন সেন্টার। চট্টগ্রামের অজ পাড়াগাঁয়ের একজন
ছেলে কীভাবে সুদূর আমেরিকায় পাড়ি জমালেন, কীভাবে তাঁর এই বিস্ময়কর উত্থান? তা জানতে হলে আমাদের
ফিরে যেতে হবে চিন্ময়ের শৈশবে।

শাকপুরা থেকে পদুচেরি:

আনন্দে আহ্লাদে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরায় চিন্ময়ের শৈশব কাটছিল। বড় দুই ভাই থাকতেন ভারতের পদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে। সেখানেই তাঁদের পড়াশোনা।
ভাইয়েরা মাঝে মাঝে দেশে আসেন। তখন আনন্দ আরও বাড়ে। কিন্তু আনন্দের এই শৈশব বেশিদিন টিকল না। ১১ বছরের শিশু চিন্ময়ের জীবনে ঘটল অঘটন। বাবা শশীকুমার অসুস্থ হয়ে মারা যান। মাও তখন অসুস্থ। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে মা তার ছোট
ছেলেকে তুলে দিলেন বড় ছেলের হাতে। মা মারা যাওয়ার পর তিনি ছোট
ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সেই বয়সেই দেশের মায়া ছিন্ন করে পদুচেরিতে আশ্রমের বাসিন্দা হয়ে ভর্তি হলেন বিদ্যালয়ে। সময়টা ১৯৪৪ সাল। লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকল শরীরচর্চা, শিল্প ও সংগীতচর্চা। এই আশ্রমের জীবনে বালক চিন্ময়ের
ভেতরে একধরনের পরিবর্তন হতে লাগল। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে অন্য কোনো কিছু তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পড়ার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। কিন্তু পাঠ্যসূচির কোনো কিছু চর্চা না করে খাতা ভরিয়ে ফেলেন
গান লিখে। সেসব গানে থাকে প্রকৃতির কথা, মানুষের মনোবেদনার কথা। নতুন নতুন গান রচনার মোহ তাকে পেয়ে বসে। নতুন কিছু সৃষ্টির নেশায় তিনি বুঁদ
হয়ে থাকেন। সেই নিবিষ্টতা পরে ধীরে ধীরে আরও গভীরতা পেল। একসময়
সেটি ধ্যানে পরিণত হলো। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন বালক চিন্ময় নতুন কথামালা সাজিয়ে গান লিখছে, নয়তো ধ্যানে মগ্ন থাকছে। ফলে প্রথাগত পড়ালেখা আর হলো না তার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই। এরপর কখনো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনো ডিশ ধোয়ার কাজ, কখনো পেনসিল তৈরির কাজ, কখনো দপ্তরির কাজ করে দিন কাটে। যেই কাজই করুক না কেন চিন্ময়ের কলম থামেনি। থামেনি তাঁর ধ্যান। একসময় আশ্রমের সচিব নলিনীকান্ত গুপ্ত তাঁকে একান্ত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন। নলিনীকান্ত নিজে লেখক ছিলেন। তাঁর লেখাগুলোকে গুছিয়ে রাখা, অনুবাদ এবং টাইপ করাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। এর মধ্যে ১৮টা বছর কেটে গেল।

পদুচেরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র:

১৯৬২ সাল। সে সময় স্যাম স্প্যানিয়ার নামে একজন মার্কিন দার্শনিক পদুচেরি এলেন। চিন্ময়ের লেখালেখি, আচার-আচরণ তাঁর ভালো লাগল। তিনি একদিন চিন্ময়কে বললেন, ‘তুমি আমেরিকায় যেতে চাইলে আমি তোমার স্পনসর হব।’ এর আগে এক অধ্যাপকের মুখে শুনেছিলেন আমেরিকার গুণগান। তিনি বলেছিলেন সুযোগ পেলেই
আমেরিকা যেতে। তখন মনের ভেতর একটা ইচ্ছা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তা সুপ্ত ছিল। স্প্যানিয়ারের প্রস্তাবে সেটিই যেন জেগে উঠল। চেষ্টা তদবির চলতে লাগল। পাসপোর্ট, পি ফর্ম ইত্যাকার নানা কিছু তৈরি করতে লাগলেন। নানা বাধা পেরিয়ে ১৯৬৪ সালের ১৩ এপ্রিল চিন্ময় ঘোষ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌছালেন। তাঁর
আশ্রয়দাতা সেই স্যাম স্প্যানিয়ার। স্পনসর পেয়ে বিদেশ যাওয়া হলো। কিন্তু বিদেশ–বিভুঁইয়ে বেশিদিন টিকে থাকা তো কঠিন ব্যাপার। গ্রিনকার্ড না পেলে সেখানে স্থায়ী থাকা যায় না। কী করা যায়? শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুদ্ধি দিলেন,
যে করেই হোক ইন্ডিয়ান কনস্যুলেটে ঢুকতে হবে, নইলে সে দেশে থাকা যাবে না। ইন্ডিয়ান কনসাল ছিলেন তখন মিস্টার মেরহোত্রা। তিনি চিন্ময়ের একটি ইংরেজি প্রবন্ধ পড়ে খুব খুশি। তিনি চিন্ময়কে চাকরি দিলেন। যৎসামান্য বেতনে ঘরভাড়া ও মাসিক
খরচ চলে না। তবু চিন্ময় খেয়ে না খেয়ে চাকরি করতে লাগলেন। তাঁর লেখালেখি, গান রচনা কিন্তু থেমে নেই। আর গভীর রাতের সেই সাধনা আর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান সমান্তরালভাবে চলতে লাগল।

যে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে:

একবার এক ইহুদি সিনেগগ ইন্ডিয়ান কনসাল জেনারেল এস কে রায়ের কাছে এসে বললেন, তাঁরা ধর্ম নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। সেখানে পাঁচটি ধর্ম নিয়ে আলোচনা হবে। এস কে রায় নিজে সেই বক্তৃতা না দিয়ে চিন্ময়কে দায়িত্ব
দিলেন।

বক্তৃতার বিষয়:

হিন্দুধর্ম ও ভারত আত্মার তীর্থযাত্রা। এটাই বিদেশে চিন্ময়ের প্রথম বক্তৃতা। সেই বক্তৃতা সেখানে বিদগ্ধজনের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। এর পরের গল্প নতুন এক চিন্ময়কে পাওয়ার। দীর্ঘদিনের সাধনা, ধ্যান, জ্ঞানচর্চায় নিজের গহিনে যে আলো জ্বলেছে তা সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যে চালক চিন্ময়কে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নাম ক্লাইভ ওয়েনম্যান। তিনি একজন ইহুদি। এই ওয়েনম্যানই বিদেশে চিন্ময়ের প্রথম শিষ্য বা অনুসারী। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল চিন্ময়ের কথা। তাঁর বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হতে লাগল মানুষ। অনেকে তাঁর সঙ্গে ধ্যানে যেতে আগ্রহ দেখালেন। এভাবে বাড়তে থাকল ভক্তের সংখ্যা। শুধু তা–ই নয়, যাঁরা তাঁর কাছে আসছেন তাঁদের অনেকেই নিজের নাম পরিবর্তন করে বাংলা নাম নিচ্ছেন। সে রকম একজন ভক্তের নাম রোজ। নতুন বাংলা নাম মুক্তি। মুক্তির সহায়তায় আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার গ্রিনকার্ড হলো তাঁর। সেটা ১৯৬৭ সালের কথা। সে বছর জুন মাসে ভারতীয় কনস্যুলেটের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। তার পর থেকে লেগে যান নিজের অধ্যাত্ম সাধনায়। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত সেই সাধনা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। গান রচনা করেছেন দুই সহস্রধিক। অসংখ্য রচনা লিখেছেন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্কটল্যান্ডের ডানডিসহ পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এসব বক্তৃতার বিষয় এবং ভাষা শ্রোতাদের মধ্যে হইচই ফেলে দেয়। অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে লাগল। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠতে লাগল চিন্ময় সেন্টার। তাঁর ভাষণ, চিন্তা লিখিতভাবে বা মুখে মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেল। মরণের পরও বিশ্বব্যাপী এক অভূতপূর্ব স্বীকৃতি পেতে লাগলেন তিনি।

সূত্রঃ প্রথম আলো

লিখা : ওমর কায়সার।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here