সেকান্দর আলম বাবর : এক সময়ের পোল্ট্রি জোন হিসেবে পরিচিত বোয়ালখালীতে বর্তমানে এ ব্যবসায় ধস নেমেছে। অন্যদিকে, পশুপাখির চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে প্রাণীর চিকিৎসা করাতে আসেন না অধিকাংশ খামারি। এদিকে, প্রাণিসম্পদ অফিসের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জনবল থাকলেও ছুটি, প্রশিক্ষণজনিত পদ শূন্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ, ওষুধ সংকটের কারণে দিন দিন স্থবির হয়ে পড়ছে সরকারি এই প্রাণিসম্পদ অফিসটি।

অপরদিকে, অসুস্থ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ গৃহপালিত বিভিন্ন প্রাণিদের ডাক্তাররা নিজের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা না দিয়ে কম্পাউন্ডার ও ড্রেসার দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন এমন অভিযোগ অনেকের। এতে করে সাধারণ মানুষ ও খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সূত্র জানায়, ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত শহরতলী বোয়ালখালী উপজেলা। এই উপজেলায় তালিকাভুক্ত ডেইরি ফার্ম রয়েছে ছোট বড় ৬৩টি। ছাগলের খামার ১২টি, মুরগির খামার ২০০টি, হাঁসের খামার রয়েছে ১০টি। গবাদিপশুর সংখ্যা ২১ হাজার ৫৪১টি, মহিষের সংখ্যা ১ হাজার ৮০৮টি, ছাগল ৯ হাজার ৫৭৫টি, ভেড়া ২২০টি, মোরগ-মুরগি ২ লাখ ৯০ হাজার ৫৩০টি, হাঁস ৩০ হাজার ৫০০টি এবং টার্কি ৫ হাজার ৮০০টি।

এদিকে, গত ১০ বছর আগে বোয়ালখালীতে যেখানে ৫’শ পোল্ট্রি ফার্ম ছিল, বর্তমানে তা ২’শতে নেমে এসেছে। এর কারণ হিসেবে উৎপাদনের তুলনায় মাংসের চাহিদা কম, মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধি ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকাকে দায়ী করেন তারা।

গত ১৮ নভেম্বর বিকালে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আবদুল হক নামে এক লোক এসেছেন তার ছাগল নিয়ে। ঘণ্টাখানেক আগে কুকুর কামড় দিয়েছে। হাসপাতালের কম্পাউন্ডার ভ্যাকসিন পুশ করলেন এবং মালিককে পথ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আরেকজন এসেছেন কবুতর নিয়ে, এটিকেও চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন ভিএফএ-এর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক।

কথা হয় খামারি খাজা ডেইরি ফার্মের মো. তসলিম উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যখন দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে ছাগল পালন, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদি পশু পালনে জনগণকে আগ্রহী করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে সরকারি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অসচেতনতা ও অবহেলায় যেমন আগ্রহ হারাতে বসেছে পশু পালনকারীরা, তেমনি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে প্রাণিসম্পদের। উপজেলার কড়লডেঙ্গার বাড়িতে পশু ও হাঁস পালনকারী আমির মিয়া জানান, গরু ছাগলের রোগ হলে গ্রামের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। সরকারি হাসপাতাল কোথায় সেটাও জানি না। খরণদ্বীপের পিউর ডেইরি ফার্মের মালিক মনোয়ারা বেগম জানান, ২০১৬ সাল থেকে দুগ্ধ উৎপাদন করছে আমার প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি সাপোর্ট পেয়েছি। না হয় এতদূর আসা সম্ভব হতো না।

সেবা নিতে আসা গরুর মালিক আহমদ হোসেন বলেন, হাসপাতালে মাঝে মধ্যে ওষুধ দেয়া হয়, মাঝে মধ্যে দেয়া হয় না।

জানা যায়, এলএসপি প্রকল্পের আওতায় পৌরসভা ব্যতীত প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে লোক নিয়োগ করা হয়েছে। তারা খামারিদের উদ্বুদ্ধকরণসহ নানান রোগ বালাই প্রতিরোধে পরামর্শ দেয়ার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। স্থানীয়দের দাবি এসব কর্মী ঠিকভাবে কাজ করলে সরকারি সুযোগ সুবিধা সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ত।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা এটি স্বীকার করে বলেন, আসলে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তারাই বার বার আসেন। অনেকে আবার একবারেই আসেন না। তারা বলেন, গরু মোটাতাজাকরণ, পোল্ট্রি খামাারি ও কসাইদের প্রশিক্ষণ, পিপিআর মুক্তকরণ কার্যক্রম রাজস্ব খাত থেকে বরাদ্দ সাপেক্ষ মাঝে মাঝে করা হলেও তা নিয়মিত নয়। এটি নিয়মিত করতে পারলে প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের আগ্রহ আরও বাড়ত।

তথ্যমতে, উপজেলা হাসপাতালে এক সময় প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ জন বিভিন্ন সেবা যেমন কৃত্রিম প্রজনন, ছাগলের ঠান্ডা, কাশিসহ ভ্যাক্সিন দিতে আসতো। বর্তমানে গবাদি পশু, হাঁস, মুরগি পালনে আগ্রহ হারানোর ফলে তা নেমে এসেছে ৩০/৪০ জনে। তাছাড়া অজ্ঞাত কারণে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষকরা।

অন্যদিকে, গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে খামারিদের। সরকারি সেবার এই দৈন্যদশার সুযোগে পশু ডাক্তারের নামে হাতুড়ে ডাক্তারের ছড়াছড়ি উপজেলায়। আর এদের হাতে গলাকাটা সেবার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুলতান মাহমুদ আকন্দ বলেন, খামারি ও পারিবারিক পর্যায়ে হাঁস-মুরগি গবাদি পশু পালন করবে তারা যেন সর্বোচ্চ সেবা পায় সেই চেষ্টা করার দাবি জানিয়ে বলেন, ইউনিয়ন ভিত্তিক জনবলের অপ্রতুলতার কারণে তা অনেকটা পিছিয়ে আছে। এখন প্রতি ইউনিয়নে লোক দেয়া হয়েছে, আগে ছিল মাত্র তিনজন। যারা বিভিন্ন কারণে গবাদিপশু ও পাখি হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারে না তাদের রোগের মেরিট অনুসারে বাড়িতে গিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি বলেন, গত বছর ৪৮ জন খামারিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের শতকরা ৫ টাকা সুদে ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তার সুফল মিলছে। দুধ ও ডিম উৎপাদনে অগ্রাধিকার আছে। যে কেউ এ উৎপাদন কাজে এগিয়ে এলে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here