মো.তাজুল ইসলাম রাজু

প্রকাশ : ১৮-১-২০২১

৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে স্কুল পর্যায়ে প্রথম শহীদ মিনার (বোয়ালখালীর কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে) নির্মাণের উদ্যোক্তা। তাঁর অনুপ্রেরণায় ১৯৬৭ সালে সেই সময় ছাত্রইউনিয়নের ছাত্রকর্মীদের প্রচেষ্টায় স্কুলে শহীদ মিনার স্থাপন , ৬৯ এর গণআন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী, একটি গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার, খেলাধুলা, সাহিত্য চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তরুণেদর উৎসাহদাতা পুরোধা ব্যক্তি, শতবর্ষী কৃষক নেতা, প্রবীণ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও প্রাণান্ত সমাজসেবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মােহাম্মদ জালাল উদ্দীন ৯৫বছর বয়সে ১৮ জানুয়ারী ২০২১ ভোরে নগরীর নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন ( ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহি রাজেউন)। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অকৃত্রিম সজ্জনকে হারালো।

এক সময় দাপুটে এবং বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

২০১১সালে বিজয়ের ৪০বছর পূর্তিতে আলোকিত বোয়ালখালীর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যয় প্রকাশিত তাঁর একটি স্মৃতিচারণ ফিচার পুণঃপ্রকাশ প্রকাশ করা হলো – মো.তাজুল ইসলাম রাজু, সম্পাদক- আলোকিত বোয়ালখালী।

তৎকালীন পাকিস্তানে সময়ে সে স্মৃতি বাক্যগুলাে এখনাে আমার মনে দাগ কাটে

-সৈয়দ মােহাম্মদ জালাল উদ্দীন

…ভারত বিভক্তির পর হতে রাজনীতিতে সক্রিয় বামধারার উল্লেখ যোগ্য রাজনৈতিক নেতা সরবিন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু দত্ত, দেবেন সিকদার, পুর্ণেন্দু দস্তিদার প্রমুখ নেতাদের সাথে সম্পর্ক ছিল। আবার নীতিগত ভাবে সময়ের ব্যবধানে সরকারপন্থি অনেক সাথেও সম্পর্ক ছিল। এতে আমার একটিই অভিজ্ঞতা হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী আমাদের বারবার গ্রাস করেছে। আমাদের নেতা বানিয়ে বুকে রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপে তাদের হয়ে কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি করার ফলে তারাই আবার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে আমাদের পদদলিত করে। যা বর্তমানে ঘটেছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে নেতার সৃষ্টি করতে হবে। নেতৃত্ব শূন্যের কারণে আমার সােনার দেশের এখন অবস্থা।

… মুক্তিযুদ্ধের সময় বােয়ালখালী একক কোন নেতৃত্ব ছিলােনা। কি পক্ষের আর কি বিপক্ষের। পক্ষের মধ্যে
ছিল আওয়ামীলীগ-মাওলানা ভাষানীর ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়ন। বিপক্ষের মধ্যে ছিল জামায়াত ইসলামী । ইসলামী ছাত্র সংঘ ও মুসলিম লীগ, পক্ষের মধ্যে আওয়ামীলীগের আধিপত্য বেশি ছিল। বিপক্ষের মধ্যে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের আধিপত্য বেশি ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিটি মিনিটই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কোন সময়ের ঘটনাকে বাদ দিলে পূর্ণতা আসবে না অন্য একটি ঘটনাতে। তাই এর ইতিহাস বর্ণাঢ্য। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কয়েকটি ঘটনাতাে কখনাে ভুলা যাবে না এমনকি মরণের আগেও। ।

… মুসলিম লীগ যারা করতেন, তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু মুক্তি বাহিনীদের ক্ষতি করেননি বরং বিভিন্ন প্রকার পরােক্ষ সাহায্য সতর্ক করে দিতেন। যা আমার বেলায়ও কয়েকবার হয়েছে।

… মুক্তিযুদ্ধ আমরা কেন করেছি। আমরা গ্রামে-গঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ না করলে দেশ হতাে না। তবে আমরা যুদ্ধ করেছি আমার মাকে বাঁচার জন্যে, আমার বােনের ইজ্জত বাঁচানাের জন্যে, আমার দেশে স্বাধীন পতাকা উড়ানাের জন্যে। মুক্তিযুদ্ধে সময়কার সামাজিক অবক্ষয়ে সকল মা তার ছেলেকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পথে, স্ত্রী তার স্বামীকে দিয়েছে অস্ত্র হাতে, বাবা তার কন্যাকে রক্ষা করেছে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে।

…আমরা আমাদের বাঁচানাের জন্য। আমাদের বংশ বাঁচানাের জন্যে আমরা যুদ্ধ করেছি। তবেই পেয়ে গেছি দেশ মানচিত্র এবং পতাকা। আজ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। তবে আমরা যার জন্য যুদ্ধ করেছি তা কি পেয়েছি? এ প্রশ্ন জনতার কাছে?

… আমার জানা মতে বােয়ালখালীতে খন্ড খণ্ড অনেকগুলাে গ্রুপ কাজ করতাে। যেমন ছিল মুক্তি বাহিনীর, তেমনি ছিল বিপক্ষ দলের। স্থায়ী ক্যাম্প কোথাও ছিল না। পােপদিয়ার বিদগ্রাম জোড়া পুকুর পাড়ে জমিদার লালার দোতলা গুদাম ঘরে আমাদের ক্যাম্প ছিল। গণহত্যাও হয়েছে কধুরখীল, শাকপুরা, উপজেলা সদরে।

…মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে দু’টো মূল্যবান জিনিষ কেড়ে নিয়েছে। একটি সামাজিক শ্রদ্ধাবােধ, যা বড়দের সাথে ছােটরা নিজেদের জাহির করার প্রত্যয় নিয়ে ব্যস্ত। অন্যটি অসত্যের দাপট। সবখানে অসতের দাপট। সত্য কথাটি বললে আমি যেন মহাভারত ভুল করে ফেলেছি। শুনতেই চাই না। মনে হয় সেই যা বলবে তা হবে। যে কারণে জ্ঞানী-গুণিরা সহসা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে গুটিয়ে নেয় এবং ভালই ভালই সুন্দর মরণের পথ খুঁজে। আমার একটি দুঃখ আমি এখনাে দু’বার চেষ্টা করে শহীদগণের কেন্দ্রীয় তালিকায় আমার ছােট ভাই ওসমান গণির নাম লেখাতে পারিনি।

… পরগাছা সবসময় অঙ্কুরেই নষ্ট করতে হয়। না হলে ডালপালা বেড়ে গেলে তা আরাে প্রকট হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধা শূন্যতায় ভুগবে। কারণ ঐ ঔপনিবেশিকরা সবসময় আমাদের ভাইয়ের মধ্যে ভাইকে লাগিয়ে দিয়ে উন্নয়নে পিছিয়ে রাখতে চাই।

…. আমাদের এলাকায় নুরুল কাদেররের বাড়িতে শান্তি কমিটির দল গিয়েছিল। সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পর ক্ষান্ত হননি তারা। তাদের স্বপরিবারে হত্যা করার পরিকল্পনায় সেখানে গেলে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের বিধ্বস্ত বাড়ি সুপারির পাটির বেড়া দেখে ফিরিয়ে আসে। তাদের বক্তব্য ছিল যাদের চাল চুলা নেই তারা কেন রাজনীতি করবে। একই সময় আমাদের বাড়িতে গেলে আমার চাচা মওলানা ফরজান আহমদ পাকিস্তানী সেনার হাত ধরে বলেন, আল্লাহর কসম এ বাড়ির কোন লােক আওয়ামী লীগ করে না। এই দু’টি কৌশলী বক্তব্যের কারণে আমরা জীবনে বেঁচে গেলাম। সে স্মৃতি বাক্যগুলাে এখনাে আমার মনে দাগ কাটে।

আরো পড়ুন-

প্রবীণ রাজনীতিক সৈয়দ জালাল উদ্দিন স্মরণে…

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here