তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরীর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে
Image captionতরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরীর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে

পেশায় আইনজীবী ফেরদৌসি রেজা চৌধুরী প্রায় দু দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের দেখাদেখি হুট করেই বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

সেবার উত্তীর্ণ হননি কিন্তু পরে আর এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহও তার ছিলোনা।

“বরং একটু স্বাধীনভাবে কিছু একটা করতে চেয়েছি। আর তখন বুঝতেও পারিনি যে এটাই একমাত্র লোভনীয় চাকুরীতে পরিণত হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মিজ চৌধুরী বলেন, “এই যে ধরুন এখন কোর্ট বন্ধ। বেকার বসে আছি। স্বামী বেসরকারি চাকুরী করেন। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিতে দুজনেই ঝুঁকিপূর্ণ। বাচ্চারা পড়াশোনা করে। অন্য কোনো আয়ের উৎসও নেই। আমাদের মতো অন্য সব পেশার লোকদেরই একই অবস্থা। ব্যতিক্রম শুধু সরকারি চাকুরেরা। বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসগুলোর রমরমা অবস্থা”।

তিনি বলেন, “সব পেশায় মানুষ চাকরী হারাচ্ছে, কিংবা বেতন বাড়াচ্ছে। অথচ এর মধ্যেও প্রমোশন পাচ্ছে সরকারি চাকুরেরা। তাই এখন মনে হয় যে বিসিএসটা ভালো করে না দিয়ে ভুলই করেছি”।

ফেরদৌসি রেজা চৌধুরীর মতো এমন অনেককেই এখন সরকারি চাকুরী না করা বা না পাওয়ার সুযোগ নিয়ে আক্ষেপ করতে যায়।

বিশেষ করে এ আক্ষেপ বাড়ে প্রতিবারই যখন বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের অনেককে নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক মাতামাতি কিংবা অভিনন্দন জানানোর ঝড় ওঠে তখন।

বাংলাদেশে কয়েকদিন আগেই ৩৮ তম বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে।

প্রায় তিন বছর আগে এই বিসিএসের প্রথম পর্বে অর্থাৎ প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন।

পরবর্তীতে কয়েক ধাপের পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ৮ হাজার ৩৭৭ জন।

এর মধ্য থেকেই মেধাক্রম অনুযায়ী ২ হাজার ২০৪ জনকে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।

সরকারি চাকরির বিভিন্ন সুবিধাদি
Image captionসরকারি চাকরির বিভিন্ন সুবিধাদি

সাক্ষাতকার আর অভিনন্দনের ঝড়

পরীক্ষার ফল ঘোষণার পরেই ফেসবুকে ঝড় ওঠে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃতদের অভিনন্দন জানিয়ে।

একটানা কয়েকটি এমন অভিনন্দনের স্রোত ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

আবার অনেকগুলো অনলাইন পোর্টাল ও নানা পত্রিকায় উত্তীর্ণ অনেকের সাক্ষাতকারও প্রকাশ করা হয়েছে বেশ মজাদার হেডলাইন দিয়ে।

‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে … এখন বিসিএস ক্যাডার’, ‘টাকার অভাবে বই কিনতে না পারা মেয়েটি হলেন এএসপি’, ‘প্রাথমিকের শিক্ষিকার ছেলে এখন প্রশাসনের ক্যাডার’, ‘পরিবারের প্রেরণায় বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন…’ ‘কখনো কোচিং করেননি বিসিএস প্রশাসনে …, ‘৩৮তম বিসিএসে… জাবির সান্ধ্য কোর্সের ..’- এমন সব হেডলাইনে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রাপ্তদের নিয়ে অনেক সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে গত কয়েকদিনে যেগুলো আবার ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে কিছু ক্ষেত্রে ব্যঙ্গ করে ট্রল করাও শুরু হয়েছে অবিকল নিউজের মতো করেই।

যেমন গত কয়েকদিনে ব্যাপক আলোচিত একটি ট্রলের শিরোনাম হলো- ‘স্ত্রীর রূপের আলোয় পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হলেন …’। জাগোনিউজ নামের একটি পোর্টালের নাম ও লোগো ব্যবহার করে তৈরি করা এ সংবাদে স্ক্রিনশট ব্যাপক হাস্যরস হচ্ছে ফেসবুকে।

যদিও জাগোনিউজ বলছে তারা এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি।

কিন্তু যে কারণে এসব ট্রল হচ্ছে তা হলো বিসিএসে বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি।

বাংলাদেশে বেশী চাকুরিজীবি কাজ করে ব্যক্তিমালাকানাধীন প্রতিষ্ঠানে
Image captionবাংলাদেশে বেশী চাকুরিজীবি কাজ করে ব্যক্তিমালাকানাধীন প্রতিষ্ঠানে

সামাজিক অবস্থান নাকি দুর্নীতির সুযোগ?

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড:ইফতেখারুজ্জামান বলছেন আজীবন চাকরীর নিশ্চয়তার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান সরকারি চাকরীর প্রতি আগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিন্তু পাশাপাশি এখানেই বৈধ আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়ের সুযোগ আছে।

“দুর্নীতি অনিয়মের জড়িয়ে পড়ে অর্থবিত্ত আর সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ প্রচণ্ড। আবার যেহেতু এদের হাতে দুর্নীতি বা অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রশাসনিক শুদ্ধাচারের দায়িত্ব তাই কার্যত দুর্নীতি করে কাউকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়না। ফলে এসব চাকরী পেলে তাকে সাফল্যই ভাবা হয়”।

তিনি বলেন আবার প্রশাসন বা পুলিশের লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেও বিপদে পড়ার নজির আছে সাম্প্রতিক সময়েই।

“একদিকে অনিয়মের সুযোগ আবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিচারহীনতার সুযোগ তৈরি করা- সরকারি চাকুরীর কয়েকটি ক্ষেত্রে এগুলো হয়েই চলেছে। ফলে অনেকেই মনে করেন এসব চাকুরীতে থাকা ব্যক্তিরা বেশ প্রভাবশালী ও বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান চাকরীর সুবাদে”।

এখানে বলে রাখা ভালো টিআইবির ২০১৩ সালের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হলো পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, আর রাজনৈতিক দল ।

আবার ২০১৮ সালের আরেক জরিপেও দেখা যায় যে সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা।

আবার ২০১৯ সালে ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার: নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

তবে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলছেন, এখন যে মাতামাতি হচ্ছে সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে।

”আগে উত্তীর্ণদের নাম শুধু সংবাদপত্রে আসতো। আবার আগ্রহ বেড়েছে কারণ বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা। আমি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চাকুরী থেকে বিদায় নিয়েছি যখন তখন মূল বেতন ছিলো আমার ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। আর এখন ওই পর্যায়ে মূলত বেতন ৮০ হাজার টাকার ওপর,” তিনি বলেন।

তিনি বলেন, “এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডোমেস্টিক কর্মীর জন্য প্রায় ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয় যেটা আমাদের সময়ে ছিলো বারশ টাকা”।

তার মতে এসব কারণে সবারই আগ্রহ বেড়েছে এবং এর ফলে মেধাবীরা সরকারি চাকরীর প্রতি বেশ আগ্রহী হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রচুর তরুণ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্ততি নিতে সময় কাটানছবির কপিরাইটBBC BANGLA
Image captionঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রচুর তরুণ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্ততি নিতে সময় কাটান

গণমাধ্যম কেন বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছে

বাংলাদেশে এক সময় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বোর্ড স্ট্যান্ডধারীদের সাক্ষাতকার প্রচার হতো পত্রিকাগুলোতে।

এখন আর সেই পরীক্ষা পদ্ধতি নেই, ফলে এ ধরণের সাক্ষাতকারও তেমন একটা দেখা যায়না।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণদের সুযোগ প্রাপ্তদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করার প্রবণতা শুরু হয়েছে।

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলছেন যেহেতু অর্থ, ক্ষমতা আর প্রভাবকেই সবাই বিবেচনায় নেয় সে কারণে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ে অতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং তার সূত্র ধরেই নিয়োগ পাওয়াদের সবচেয়ে সফল বিবেচনা করা হচ্ছে।

যারা চাকুরী করছেন তাদের ভাবনা কেমন

মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কেউই নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজী হননি।

তবে একজন কর্মকর্তা বলেছেন ক্যাডারগুলোর কাজের পরিধি এবং সুযোগ সুবিধার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দু একটি ক্যাডারকে বেশি ক্ষমতাশালী ভাবতে শুরু করেছে অনেকে।

একজন ইউএনও বলেন, “প্রশাসন আর পুলিশের প্রভাব আর ক্ষমতা বেশি। মানুষ একটু ক্ষমতা তোষণ করতে ভালো বাসে। ম্যাক্সিমাম মানুষের জমিজমার সমস্যা থাকে, উপজেলায় নানা কাজ থাকে তাই প্রশাসনের বড়ভাই বন্ধুদের কাছে রাখতে চায়। আর পুলিশ তো এখন বলতে গেলে ভীষণ ক্ষমতাধর। এলাকায় প্রতিপত্তি শো অফ করতে এদের লাগে। ফলে সবার কাছেই এ দুটি ক্যাডারকে ভিন্ন মনে হচ্ছে”।

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, “আমি যে উপজেলায় কর্মরত আছি সেখানে সরকারি কলেজে বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক আছেন, এখানে বিসিএস ক্যাডার আরও অনেক অফিসে (শিক্ষা, কৃষি, সমবায়) আছেন। কিন্তু এদের অনেকেই দীর্ঘকাল কোনো পদোন্নতি পাননা। আমি পদোন্নতি পেয়ে চলে যাবো কয়েকদিন পর। আর উনাদের কি হবে কেউ জানেনা। এসব কারণেও আমাদের প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডার নিয়ে এমন মাতামাতি হয়, যাতে আমরাও আসলে বিরক্ত এখন”।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here