অসুখ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে মতভেদ হলে রোগীর যে করুণ দশা সংগীত নিয়ে আমাদেরও তাই। বিভিন্ন আলেম বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন, জনগণের কে কার মতামত মানবেন সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা মানছি ‘দুনিয়ার সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ইসলামী বিশেষজ্ঞ’দের মতামত, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাণ্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক এবং ডক্টর ইউসুফ কারযাভীর মত।

ইউসুফ কারযাভী তার প্রজ্ঞার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। তার পরিচয় দেখুন-

১. বিশ্বের সর্ববৃহৎ অন লাইন ফতোয়া-সংগঠন “ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ”-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট,

২. আন্তর্জাতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড-এর উপদেষ্টা ছিলেন,

৩. আন্তর্জাতিক আলেম-সংগঠন “ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স”-এর চেয়ারম্যান ছিলেন,

৪. বিশ্বময় “ইসলামী ব্যাঙ্কিং” এর প্রভাবশালী আলেম,

৫. কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান,

৬. “মুসলিম-বিশ্বের নোবেল” নামে বিখ্যাত “বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার” পদক পান,

৭. “ব্যাংক ফয়সল” পুরস্কার লাভ করেন।

৮. ব্রুনাই সরকার তাকে “হাসান বাকলি” পুরস্কার প্রদান করে।

মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) গ্র্যান্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক (বিস্তারিতের জন্য সার্চ করুন “Al Azhar university – music in Islam, দি ইসলামিক টেক্সট ইনস্টিটিউট) এর মতে- “অনৈতিক ও গুনাহ-এর কর্মকাণ্ডের সহিত যুক্ত না হইলে, কিংবা সেই বাহানায় মানুষকে হারামের দিকে না টানিলে, কিংবা মানুষকে ফরজ ইবাদত (আল ওয়াজিবাত) হইতে সরাইয়া (বা ভুলাইয়া) না দিলে সংগীত শোনা, সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ”।

ডক্টর কারযাভীও একই কথা বলেছেন- “কাজী আবুবকর ইবনুল আরাবী বলিয়াছেন ‘গান হারাম হওয়া পর্যায়ে একটি হাদিসও সহীহ নহে’। ইবনে হাজম বলিয়াছেন – ‘এ পর্যায়ের সকল বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত’… এ পর্যায়ে বর্ণিত নিষেধমূলক হাদিসগুলি সমালোচনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ….বহুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন গান শুনিয়াছেন,… যে গানের সাথে মদ্যপান, ফষ্টিনষ্টি ও চরিত্রহীনতার মতো কোনো হারাম জিনিসের সংমিশ্রণ হয় সেই গান হারাম… রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন- ‘কার্যাবলীর ভালোমন্দ নির্ভর করে তাহার নিয়তের ওপর।’ কাজেই যেই লোক এই নিয়তে গান শুনিল যে তাহার দ্বারা গুনাহের কাজে উৎসাহ পাওয়া যাইবে তাহা হইলে সে ফাসিক। পক্ষান্তরে যেই লোক স্বভাব মেজাজের সুস্থতা লাভের উদ্দেশ্যে শুনিল, আল্লাহর আনুগত্য কাজে শক্তি সাহস পাওয়ার এবং ভালো ও সৎকাজে আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে শুনিল, তাহার এই কাজ নিশ্চয়ই অন্যায় বা বাতিল নহে। আর যেই ব্যক্তি না আল্লাহনুগত্যের নিয়তে শুনিল না নাফরমানি নিয়তে, তার এই কাজ নিষ্ফল কাজের পর্যায়ে গণ্য।” (ইসলামে হালাল হারামের বিধান- পৃষ্ঠা ৪০৬ – ৪১১)

এবারে কোরান।

সংগীতের আরবী হচ্ছে “মুসিকি”, সারা কোরানে ওই “মুসিকি” শব্দটাই নেই। কোরান কোথাও সংগীতকে নিষিদ্ধ করেনি অথচ “সঙ্গীত হারাম” দাবি করা হয় কোরানের দুটো আয়াত দিয়ে-

(১) সুরা লোকমান ৬ নম্বর আয়াত− “একশ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ হইতে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে,

এবং

(২) বনি ইসরাইল ৬৪ নম্বর আয়াত (আল্লাহ শয়তানকে বলছেন) −“তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সত্যচ্যুত করে তাদেরকে আক্রমণ কর।”

সঙ্গীত-বিরোধীরা বলেন সুরা লোকমান ৬-এর অবান্তর কথাবার্তা-ই নাকি সঙ্গীত (মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরানের অনুবাদ, পৃঃ ৭৮৩ ও ১০৫৩-৫৪)। কি হাস্যকর! আম জিনিসটা আম-ই। জামও নয়, কাঁঠালও নয়। অবান্তর কথাবার্তা অবান্তর কথাবার্তাই, অন্যকিছু নয়। একই খেলা করা হয়েছে বনি ইসরাইলের ৬৪ নম্বর আয়াত নিয়েও। আয়াতটা হলো, মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ব্যাপারে আল্লাহ শয়তানকে অনুমতি দিচ্ছেন: “তুই সত্যচ্যুত করে তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, স্বীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ কর”। অথচ এর অনুবাদ করা হয়েছে: “তুই তোর…রাগ-রাগিনী গান-বাজনা ও বাদ্যবাজনা দ্বারা …।”

সংগীত-বিরোধী হাদিসগুলো ভিত্তিহীন তা আমরা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কাছ থেকে শুনলাম। সংগীতের পক্ষে অজস্র হাদিস আছে, লম্বা হয়ে যাবে বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছিনা। এবারে চলুন আরো কিছু দলিল দেখা যাক।

১. অখণ্ড ভারতের সর্বোচ্চ ইসলামি নেতাদের অন্যতম, ভারতীয় কংগ্রেসের দুইবারের সভাপতি, কলকাতার ঈদের নামাজ পড়ানোর পেশ ইমাম মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন: “পয়গম্বর দাউদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মিষ্টি ছিল। তিনি সর্বপ্রথম হিব্রু সংগীতের সংকলন করেন ও মিশরের ও ব্যাবিলনের গাছ হইতে উচ্চমানের বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনা করেন”। (তর্জুমান আল্ কুরান, ২য় খণ্ড পৃঃ ৪৮০।)

২. “হজরত ওমর(রঃ)-এর আবাদকৃত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় হইল বসরা। আরবি ব্যাকরণ, আরূয শাস্ত্র এবং সংগীতশাস্ত্র এই শহরেরই অবদান” (বিখ্যাত কেতাব ‘আশারা মোবাশশারা’, মওলানা গরীবুল্লাহ ইসলামাবাদী,  ফাজেল-এ দেওবন্দ, পৃষ্ঠা ১০৬।)

৩. ইমাম গাজ্জালী: “নবী করিম (সাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে বলিয়াছেন − তাঁহাকে হযরত দাউদ (আঃ) এর সংগীতের অংশ প্রদান করা হইয়াছে।” (মুরশিদে আমিন, পৃষ্ঠা ১৭০ − এমদাদিয়া লাইব্রেরি)

এরকম অজস্র দলিল আছে। ‘অশ্লীল আদেশ শয়তান দেয়’ (সুরা নূর ২১)। কাজেই সংগীতসহ শ্লীল কোনোকিছু হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। গানের কুৎসিৎ কথা, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি বা গানের অতিরিক্ত নেশায় জীবনের ক্ষতি ইত্যাদির সীমা টানেননি ধর্মান্ধরা, পুরো সংগীতকেই ঢালাওভাবে বাতিল করেছেন। করে লাভ কিছুই হয়নি বরং সংগীত আজ সুবিশাল বিশ্ব-ইন্ডাস্ট্রি। দুনিয়ায় কোটি কোটি সংগীতপ্রেমী পরিবার পালছেন, বাচ্চাদের বড় করছেন, প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছেন। সংগীত হলো আমাদের সসীম জীবনে এক টুকরো অসীমের ছোঁয়া। চারদিকের আকাশবাতাস সাগর-পর্বত গ্রহ-নক্ষত্র, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিপুল সুরস্রষ্টার মহাসংগীত। তাই, গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হারাম নয়। ‘আমি বাংলার গান গাই’, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, ‘কান্দে হাছন রাজার মন ময়না’, মায়েদের মধুকণ্ঠে ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। শ্লীল সংগীত ইসলামে হারাম নয়।

‘কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ’ (মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও বিদায় হজ্বের ভাষণ)। সঙ্গীত হারাম মনে করলে শুনবেন না, অসুবিধে কী। কিন্তু যারা সংগীত ভালোবাসেন, সংগীতের পক্ষের বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কথা বিশ্বাস করেন, তাদেরকে আঘাত করাই সেই ইসলাম-বিরোধী বাড়াবাড়ি।

হাসান মাহমুদ , মুসলিম রিফর্ম মুভমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মী, শারিয়া আইনের ওপর গবেষক, লেখক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বক্তা।

https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/59335?fbclid=IwAR365cgVBUBbMVw4BOOl_ygs9lyC03p3S22r3HZ8huSn67hqig5kyClfAAA

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here