মুস্তাফা নঈম
আধুনিক ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে নতুন প্রজন্মের বিরাগের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে লোক সঙ্গীত ও দেশী বাদ্যযন্ত্র সমূহ। ক্রমক্ষয়িষ্ণু বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঢোল অন্যতম। এই বিলুপ্ত প্রায় বাদ্যযন্ত্র ঢোল নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন অকৃত্রিম সাধনার মাধ্যমে যারা আমাদের প্রাচীনতম নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে রেখে নিজেদের এবং ঢোল ব্যবহারকে এখনও মহিমান্বিত করে রেখেছেন তার একজন বিনয়বাঁশী জলদাস। তিনি ঢোল থেকে বের করে এনেছেন অপূর্ব রিদম যা তার বাদন না শুনলে উপলব্ধি করা অসম্ভব।
এই প্রখ্যাত ঢোলবাদক তার জীবনের সুবর্ণ সময় অতিবাহিত করেছেন লোক কবি সম্রাট ও উপমহাদেশখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের সহযোগিতায়। ১৯১১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পূর্ব গোমদন্ডীর ছন্দারীয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন বিনয়বাঁশী জলদাস। ১০/১১ বছর বয়স থেকেই স্বগ্রামের ত্রিপুরা চরণ, ও পাশের গ্রাম রাইখালীর লক্ষীন্দর জলদাসের কাছেই তাঁর ঢোল বাদনের হাতে খড়ি।
পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যশিক্ষা শেষ করার পর আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু কিশোর বিনয়বাঁশী ঢোলের অকৃত্রিম ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েন। পারিবারিক মত্স্যজীবির পেশা ছেড়ে নিমগ্ন হয়ে পড়েন ঢোল বাদনের সাধনায়। এই জন্য তাকে ভোগ করতে হয়েছে অনেক লাঞ্চনা ও বঞ্চনা। পরতে হয়েছে অর্থকষ্টে। হৃদয়ে যার শিল্পী সত্তা লুকিয়ে থাকে তাকে বেঁধে রাখতে পারে না কোন বন্ধন। শিল্প সাধনের টানে একসময় বিনয়বাঁশী যোগ দেন এদেশের লোকশিল্প মাধ্যম যাত্রাপালায়।
যাত্রায় বিনয়বাঁশী কখনো গান, কখনো নাচ, কখনো অভিনয় পরিবেশন করতে থাকেন। এ সময় তিনি তবলা, মৃদঙ্গ, বেহালা, দোতারা, সানাই, হারমনিয়াম সহ বিভিন্ন যন্ত্রে তালিম নিতে থাকেন। এ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে বিনয়বাঁশী ধীরে ধীরে শিল্পকলার একটি বিশেষ শাখা ‘বাদন’ শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়েন। যাত্রা দল ছেড়ে ফিরে আসেন ঘরে। এ সময় প্রছন্ড অস্থিরতায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। যা সম্ভাবনাময় যে কোন শিল্পীর অন্তলোকে কাজ করে। যাত্রাদল থেকে ফিরে আসা তরুন বিনয়বাঁশী যোগ দেন কবিগান ও পালা কীর্তনের দলে। এই পালা কীর্তনের সূত্র ধরে বিনয়ের সাথে পরিচয় ঘটে প্রখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের সাথে তার সহযোগী ও ঢোলবাদক হিসেবে ঘুরেছেন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সাথে সাথে পরিণত ও পরিপক্ষ হতে থাকে বিনয়বাঁশী। ৬ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক বিনয়বাঁশী। তাঁর ছেলেদের শিখিয়েছেন ঢোলবাদন। তারা পেশা হিসেবে নিয়েছে এই বাজনা। উৎসব, পূজা- পার্বণ, বিয়ে-শাদীতে ঢোলবাদন পরিবেশনা হয়ে উঠেছে অনিবার্য।
বিনয়বাঁশী তাঁর নিপুন আঙ্গুল ও কাঠির ছোঁয়ায় ঢোলের খোলের গভীর হতে তুলে আনেন বাহারী ছন্দময় ঝংকার। ঢোলের কানফাটা আওয়াজ অসহনীয়। কিন্তু বিনয়বাঁশী ও তার উত্তর প্রজন্মের বাজানো ঢোল থেকে বেরিয়ে আসা শব্দমালা যেন ইন্দ্রপুরীর সুরেলা ঝংকার।
তিনি ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক `একুশে পদক’ লাভ করেন। ২০০২ সালের ৫ এপ্রিল এই কিংবদন্তী শিল্পী পরলোক গমন করেন।
২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হে গুণীজন
-লেখক ও সাংবাদিক।