‘স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর আমি দুজন প্রিয়’-
এমন স্বপ্ন নিয়ে দু’জন মানুষ বিয়ে নামক সম্পর্ক দিয়ে সামাজিকভাবে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেখানে ভালোবাসা দিয়ে সুখের সংসারের স্বপ্নটা ছাড়া কিছুই থাকে না। সারাজীবন দু’জন দু’জনার হয়ে একসাথে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দাম্পত্য জীবনে কেউ ঘর বাঁধে নিজেরা ভালোবেসে, আবার কেউ পারিবারিকভাবে সম্বন্ধ করে। সম্পর্ক যেভাবেই হোক না কেন, সেখানে দাম্পত্যকলহ বা বিচ্ছেদ আসুক তা কেউ চায় না।
কিন্তু আবেগ আর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কখনো কখনো বিচ্ছেদ শব্দটাই জীবনের সব রং মুছে দেয়। যা স্বপ্নে দেখা ঘর সংসার সন্তান সব কিছুকে শেষ করে দেয় ধীরে ধীরে। আর এমন পরিস্থিতিতে স্বামী স্ত্রীকে যে বিষয়টি বুঝতে হয় তা হলো, বিয়ে নামক সর্ম্পক দিয়ে দুজন মানুষের মিলনে যেমন অনেক দায়বদ্ধতা থাকে, তেমনি বিচ্ছেদে সে দায়বদ্ধতার ভার অনেক বেশি বইতে হয় গোটা পরিবারকে। যার প্রথম শিকার সন্তান।
প্রেম এর আছে নানা রুপ নানা রং। তাই আবেগময় জীবনে দুজন মানুষের সর্ম্পকের পরিপূর্ণতা পায় তাদের সন্তান দিয়ে। সে সন্তান তার বাবা মায়ের কাছ থেকে শেখে পরিবারের প্রতি পারস্পরিক ভালোবাসা, মায়া-মমতা, জানে জগতকে।
যখন একটি পরিবারের কাণ্ডারি বাবা মায়ের সম্পর্ক তিক্ততাতে পরিণত হয়, তখন সেখানে নেমে আসে দুর্বিষহ পরিবেশ। যেখানে সন্তানরা হয়ে পড়ে অসহায়। সে অবস্থায় তাদের কাছে প্রশ্নের জন্ম দেয়, বাবা ভালো না মা ভালো? কারণ দু’জনই ঝগড়ায় পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করে কাদা ছোঁঁড়াছুড়ি করে সন্তানের সামনে। আলাদা হবার কথা আসে। তখন সন্তান ভাবে বাবা মা নিয়ে এক ঘরে থাকা হবে না আর। তাহলে সে কার কাছে যাবে?
এই যে প্রশ্নগুলো সন্তানের মনে জাগে, এর প্রভাব সারা জীবন বয়ে বেড়ায় সে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সন্তানকে স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সবখানে শুনতে হয় ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চা’।
কিন্তু দু’জন মানুষের অমিলের মাঝে সন্তান নিয়ে টানাটানি করার আগে তাদের নিজেদের ভাবা উচিৎ, আমরা আমাদের সন্তানদের মানসিকভাবে কতটা ক্ষতি করছি।
এ অবস্থাতে পরিবারে সন্তানদের সামনে কলহ বিবাদ না করে তাদেরকে বাস্তবতা বুঝাতে হবে। তৈরী করতে হবে আগামী দিনের বৈরী পরিবেশের মাঝে বড় হতে। একজন সন্তানের কাছে বাবা-বাবাই, মা মা- ই। সে প্রাপ্ত বয়স্ক না হবার আগে জীবনের অনেক কিছুই বুঝবে না। তাই সন্তানকে মিথ্যা দ্বারা কিছু না বুঝানো শ্রেয়। বরং একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যদিয়ে তাকে সুযোগ দিতে হবে সব বুঝতে ।
অনেক ক্ষেত্র দেখা যায়, এসব পারিবারিক জটিলতায় সন্তানরা বিপথে যায়। তারা তাদের মত করে বাঁচার পথ খুঁজে নেয় মাদক কিংবা অন্য যেকোনো অনৈতিক পথ। সন্তান বিপথে গেলে সেটাও মা বাবার জন্য চরম কষ্টের হয়, যেখান থেকে মুক্তি পাবার সুযোগ থাকে না।
তাই বলে বলছি না, সন্তানের মুখ চেয়ে নিজেদের অমিল নিয়ে এক ঘরে থাকতে হবে। তার চেয়ে অনেক উত্তম নিজেদের মধ্যে বিবাদ হলে বোঝা পড়ার মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয়ে স্বাভাবিক জীবন বেছে নেওয়া।
তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দেখা যায়, এ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্তানকে সালিশ-বিচার এমনকি আদালতে নিয়ে যাওযা সে কার সাথে থাকবে তা জানতে। যেখানে ছেলে মেয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। তাও তাদের মুখে শুনতে হবে সব কিছু। একবারও কি কেউ চিন্তা করে দেখেছেন, আদালতের বারান্দায় বা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সন্তানের ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যায় তখন? কিংবা আগামী জীবনে সে পরিবার শব্দটির প্রতি কতটা বীতশ্রদ্ধ হবে এ ঘটনা থেকে?
গল্প সিনেমাতে নয় বরং বাস্তব জীবনে দেশের আদালতে এমন অনেক ঘটনা আছে, সন্তানদের অসহায়ত্ব আর চোখের জলে বিচারকেরও অশ্রু ঝরেছে। এমন ক্ষেত্রে আদালত চেষ্টা করে সন্তানদের জন্য বাবা মায়ের বিচ্ছেদ রোধ করতে। কখনো সফল হয় কখনো হয় না। আদালত বা সামাজিক বিচার সালিশ বাবা মাকে অনুরোধ করতে পারে তাদের সন্তানদের প্রতি সদয় হতে এর বেশি কিছু নয়। কারণ যে সম্পর্ক আবেগ ভালোবাসা দিয়ে শুরু হয় তার বিচ্ছেদে আইনের ধারাগুলোই হয় মুখ্য। সেখানে ভালোবাসা প্রেম বলে কিছু থাকে না। তবে সন্তানদেরকে এ আইনী নিয়মের কঠিন ভারটা সইতে হয়। কারণ তারা যে মা বাবা দুজনকেই ভালোবাসে। কিন্তু সে ভালোবাসা পরাজিত হয় বাবা মায়ের বিচ্ছেদে।
এমন পরিস্থিতিগুলোতে বাবা মা কী সিদ্ধান্ত নিবে তা হয় সময় সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু তাদের প্রতি সন্তানদের করুণ চাহনির অন্তরালে বিষাদের ছায়া বুঝে না হয়ত কেউ। এমনকি বাবা মা দুজনের কেউই একবার ভাবতে পারে না আজ তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রথম শিকার তাদের সন্তানরা। আদালত হয়ত আইনগত অধিকার দিতে পারে। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা কারো কমাতে পারবে না। তাই আইনে বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর সন্তানের অধিকারসহ সকল বিষয়ে বিধিবিধান থাকার পরেও সন্তানকে আদালতে হাজির না করার বিষয়টা মানবিকভাবে বিবেচনা করা দরকার।
কথায় বলে ‘জোড়াতালি দিয়ে আর যাই হোক সংসার হয় না’। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালবাসা নিজেদের বোঝাপড়ার নাম হল সংসার। সে সংসারে সন্তান হলো দুটি মানুষের অস্তিত্বের প্রতীক। সংসারের বিকশিত রূপ। তাই সর্ম্পকের মাঝে যখন বিচ্ছেদ হানা দেয়, তখন সন্তানদের হাতিয়ার করে নিজেদের প্রতিহিংসার প্রকাশ না ঘটানো শ্রেয়। সন্তানের জন্মে বাবা মায়ের নিজেদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। ঠিক একইভাবে বাবা মায়ের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব সন্তানদের সুষ্ঠু সুন্দর জীবন গড়া। তাদের ভুলে গেলে চলবে না বিচ্ছেদ নামের শব্দটি দিয়ে সবার আগে বিপর্যস্ত হয় তাদেরই সন্তানদের জীবন। তাই আইনগত ও সামাজিক অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সন্তানদের স্বচ্ছ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বাবা মাকে। কারণ তাদের দাম্পত্য জীবনের কলহের দায় সন্তানদের নয়।