আলোকিত প্রতিবেদক:
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো, আমি গাইবো বিজয়ের গান।’ তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস অবরুদ্ধ বাংলার সব অর্গল খুলেছিল একাত্তরের এই দিনে। উন্মুক্ত সুনীল আকাশের মুক্ত বাতাসে মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। কালের পরিক্রমায় আজ সেই মহান বিজয় দিবস। আজকের প্রভাতে পূর্ব দিগন্তে উদিত সূর্য লাখো হরিদাসীর মুছে যাওয়া সিঁথির সিঁদুরে রাঙা।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির গৌরবময় বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হলো আজ। এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরবের মহিমায় সমুন্নত অনন্য এই দিনটি। এমন একটি দিনের প্রতীক্ষায় এ দেশের মানুষ প্রহরের পর প্রহর গুনেছে, লড়াই করেছে জীবন বাজি রেখে, ঝরিয়েছে বুকের তাজা রক্ত। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দখলদার পাকস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
দেশের সর্বত্র আজ আনন্দ-উৎসব, শোক ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সম্মিলনে পালিত হবে জাতীয় জীবনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই দিন। এ বছর দিবসটির তাৎপর্য অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি আনন্দময়। ২০১৪ সালে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা শুরু হয়েছিল কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে, আর এবারের বিজয় দিবসের আগে দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলবদর কমান্ডার আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করায় উৎফুল্ল জাতি। একদিকে জাতির ললাটের কলঙ্ক তিলক মোচনের যাত্রা শুরু; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের নেয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষা, সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদানের নানা উদ্যোগে নতুন আশা জেগেছে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের মনে।
পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীসহ সা¤প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানা অপতৎপরতায় জাতির জীবনে নানা আশঙ্কার উদ্ভব ঘটেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী হামলা জাতিকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় দেশকে উদ্ভাসিত করার দৃঢ় আহ্বানও উচ্চারিত হচ্ছে প্রগতিশীল সব মহল থেকেই। জাতি আজ আনন্দ-উৎসব ও শোক-শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সম্মিলনে বিজয়ের দিনটি উদযাপনের পাশাপাশি সে শপথেও বলীয়ান হবে। এবারের বিজয় দিবসে বাঙালি জাতি তাই আবারো শপথ নেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করার এবং একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের নির্মূল করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে সফল ও সার্থক করে তোলার। শপথ নেবে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপ দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। এবারের বিজয় দিবসে বাঙালির শপথ হবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও হানাহানিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। এবারের বিজয় দিবসে যে কোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শপথ নেবে বাংলার মানুষ।
আর এভাবেই গোটা দেশবাসী আজ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে মহান বিজয় দিবস।
বীর বাঙালির ইতিহাস গড়ার ইতিহাস : বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনের ইতিহাস শুধু ১৯৭১ সালে সীমাবদ্ধ নয়। ইস্পাতকঠিন ঐক্যে দৃঢ় জাতির দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের সুমহান ফসল এ বিজয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী আঘাত করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। শুরু হয় শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যের করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সে শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম স্ফুরণ ছিল ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহর এমন ঘোষণার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত পরিণতি পায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে বাঙালির বিজয় এবং তা কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এসব সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের জন্য গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষার বিস্ফোরণ। জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৬ দফা থেকে একের পর এক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়। সে বিজয় পাকিস্তানি শাসক চক্র প্রত্যাখ্যান করলে ১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে আসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অমোঘ বাণী, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মূলত সেদিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। কিন্তু বাঙালিকে স্তব্ধ করতে ২৫ মার্চ কালরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করা হলো বঙ্গবন্ধুকে। তার আগেই গণহত্যা শুরুর পর মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াই মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস ধরে চলা সে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের আরেকটি মহান অধ্যায়। সে অধ্যায়ে ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অসম সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথা। ১৭ এপ্রিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ঘনিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ হানাদার সেনা। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মানচিত্র।
বিজয় দিবসের দিনে আজ বিজয়োল্লাসে ভাসবে দেশ, জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশে বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক এসব বাণীতে তারা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।