সংকলন: মো. তাজুল ইসলাম রাজু
আশুতোষ চৌধুরী। চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল গ্রামে ১৮৮৮ (২৩ কার্ত্তিক, ১২৯৫ বাংলা) সালে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে যারা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে আশুতোষ চৌধুরী এক অনন্য নাম। পিতা- কৈলাশচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান স্কুল শিক্ষক। মাতা কৌশল্যা চৌধুরী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। গ্রাম ছেড়ে তাঁর শেষ জীবন কেটেছে চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকাননে ‘নিভৃত নিলয়’-এ।

তিনি ছিলেন একাধিক গুণে গুণান্বিত। তিনি বাংলার পল্লী গীতিকা সংগ্রাহক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার।
বিদ্যার্জনে কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পাঠ নেয়া শুরু করেছেন, তার কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেননি। তবে এন্ট্রাস ও মোক্তারি পাস করে তিনি কিছুদিন মোক্তারি করেন বলে তাঁর পারিবারিকভাবে জানা যায়। কিন্তু তিনি ছিলেন আপাদমস্তক শিক্ষক; তাই মোক্তারি চাকরিতে তাঁর মন টেকে নি। ১৯৩৭ সালে শিক্ষক আন্দোলনের অংশ হিসেবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষকদের সাধারণ সভায় তিনি বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জোরালো বক্তব্য রাখেন।

তিনি শিক্ষকতা পেশাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং প্রথমদিকে কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতা করার পর রাউজান আর আর এ সি ইন্সটিউটশনে প্রধান পন্ডিত পদে যোগদান করেন। আশুতোষ চৌধুরী সাহিত্য চর্চা করতেন। এ সময় তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই ছোটদের ‘চট্টলভূমি’ নামে একটি ভূগোল বই রচনা করেন। এটি মূলত ভূগোল বই হলেও এতে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছোঁয়া ছিল। এতে তার কবি প্রতিভার উন্মোচন ঘটে। এই বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান ড. দীনেশচন্দ্র সেনের হাতে পড়ে। এই বইটির সূত্র ধরেই তার পরিচয় ঘটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যক্ষ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে।

দীনেশচন্দ্র সেন আশুতোষ চৌধুরীর সাথে যোগযোগ স্থাপন করে তাঁকে ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লীগীতি সংগ্রাহকরূপে নিযুক্ত করেন। এর থেকে আশুতোষ চৌধুরী পল্লীগীতি সংগ্রহ ও সাহিত্য চর্চায় জীবন অতিবাহিত করেন। আশুতোষ চৌধুরী ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লীগীতির সংগ্রাহক ছিলেন। স্বভাবকবি ও গীতিকার হিসেবে আশুতোষের খ্যাতি হয়েছিল। তিনি বছরের পর বছর চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে লোকগান/কাহিনী সংগ্রহ করেছেন।

তিনি যে কয়টি পালাগান সংগ্রহ করেন সেগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ গীতিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘গীতিকা’। চট্টগ্রামী ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অভিধান তাঁর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য কর্ম। এই গ্রন্থে তিনি চট্টগ্রামী শব্দ সংগ্রহ ও চট্টগ্রামের সংস্কৃতি বিষয়ক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর বহু পরিশ্রমে সংগৃহীত এই অমূল্য গ্রন্থের পান্ডুলিপি ভারতের জাতীয় অধ্যাপক পরলোকগত আচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নিকট সংরক্ষিত ছিল বলে জানা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় পান্ডুলিপিটি আর উদ্ধার হয়নি। আশুতোষ চৌধুরীর আরো কয়েকটি অপ্রকাশিত রচনার কথা শোনা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশনা প্রকল্প বাতিল হয়ে যাওয়ায় আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত চট্টগ্রামের আরো বহু পালাগান ও পল্লীগীত প্রকাশিত হয়নি।

আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত চট্টগ্রামের পালাগানের মধ্যে ‘নুরুন্নাহার ও কবরের কথা, ভেলুয়া সুন্দরী, কমল সওদাগর, কাফন চোরা, নেজাম ডাকাতের পালা, হাতী খেদা, নসর মালুম এই সাতটি পালাগান এবং সুজা তনয়ার বিলাপ ও পরীবানুর হঁলা’ নামে দু’টি গাথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ’ গীতিকার বিভিন্ন খন্ডভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘদিন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেন লুপ্তপ্রায় একাধিক পালাগান, যা বাংলা সাহিত্য সম্ভারকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি চট্টগ্রাম, আরাকান, ত্রিপুরা অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় প্রায় ৭৬টি পালাগান সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে দীনেশ চন্দ্র সেনের পূর্ববঙ্গ গীতিকায় ৯টি সংকলিত হয়। লোকগীতিকার সংগ্রহে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক চন্দ্র কুমারের পরই আশুতোষ চৌধুরীর স্থান। এ ছাড়া আশুতোষ চৌধুরী বারোমাসি ও হঁলা (বিয়ের গান) ও মাইজভাণ্ডারি গান সংগ্রহ করেন। তাঁর অপ্রকাশিত দুটি গীতিকা হচ্ছে ‘মজুনা’ ও ‘দেওয়ান নুহর’।

আশুতোষ চৌধুরী ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে কবি ওহীদুল আলমের সাথে যৌথভাবে চট্টগ্রামের মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘পূরবী’ সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকায় তাঁর বহু কবিতা, প্রবন্ধ ও ‘মগ ফিরিঙ্গ’ নামক একটি নাটক প্রকাশিত হয়। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে পূরবী ছাপা হতো। অফিস ছিলো আন্দরকিল্লা ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী সুচরিত চৌধুরী তাঁর সুযোগ্য সন্তান। কবি-সাহিত্যিক ও লোকগীতি সংগ্রাহক আশুতোষ চৌধুরী লিখিত বহু সংখ্যক প্রবন্ধ, নাটক ও কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যথাক্রমে জ্যোতি (১৩৩৬বাংলা), যগধর্ম (১৩৪২বাংলা ), দৈনিক পাঞ্চজন্য (১৩৪২বাংলা), পূরবী (১বাঙলা), সত্যবার্তা (১৩৪৪বাংলা), যুগশঙ্খ (১৩৪১বাংলা), প্রভাতী (১৩৪৫বাংলা), সীমান্ত (১৩৫৪ বাংলা) পত্রিকায় একাধিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

জীবনের শেষভাগে চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন-এ নিজ বাড়ি ‘নিভৃত নিলয়’-এ বসবাস করেন এবং এখানেই ১৯৪৪ সালের ২৭ মার্চ ৫৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here