শ্রী বিজয় শংকর চৌধুরী

বাংলাদেশে শ্রীঅরবিন্দ চর্চার প্রথম পীঠস্থান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের কলােমিটার দূরে শাকপুরা গ্রামের মধ্যভাগে সুন্দর মনােরম পরিবেশে পরমদেব মজারবিন্দ ও শ্রীমায়ের প্রত্যক্ষ অনুমতি প্রাপ্ত মহান সাধক শ্রী মােহিনী মােহন দত্ত সর্তক ১৯৪২ইং সনে প্রতিষ্ঠিত “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” এখনও কালের সাক্ষীরূপে তার আলােকছটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯৪২ইং সনের ২ আগষ্ট রবিবার এ আধ্যাত্মিক। চর্চার কেন্দ্রটির দ্বারােদঘাটন অনুষ্ঠানের বিবরণ কলিকাতার বাইরে তদানীন্তন চট্টলার একমাত্র দৈনিক “পাঞ্চজন্য” পত্রিকার ৪ আগষ্ট ১৯৪২ ইং তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক শ্রী সুবােধ রায়, সর্বশ্রী প্রকৃতি রঞ্জন বড়ুয়া, সুরেন্দ্র বিজয় চৌধুরী, ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ভূবন। মােহন দত্ত, অতুল চন্দ্র সেন প্রমুখ। আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীঅরবিন্দ-শ্রীমায়ের দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও শিক্ষা চর্চার অনুপম এ আশ্রম প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব হতেই অর্থাৎ ১৯১৮ইং সন হতেই মধ্য শাকপুরা গ্রামের দত্ত বাড়ীটি পরিচিতি পেয়ে আসছিল “সাধন বাড়ী” নামে, যা পণ্ডিচেরী শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের বাইরে নিশ্চিতরূপে শ্রীঅরবিন্দের আধ্যাত্মিক শিক্ষা চর্চার একমাত্র আদি কেন্দ্র।

মন্দিরের সম্মূখভাগ
মন্দিরের সম্মূখভাগ

আমরা চট্টগ্রামবাসী অত্যন্ত ভাগ্যবান একারণে যে, পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে যে এক বিপ্লবাত্মক রূপান্তর সাধিত হয়ে চলেছে তার অন্যতম এক পীঠস্থান হিসাবে শাকপুরা গ্রামের এ আশ্রম তথা “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। এক তীর্থস্থানে পরিণত হবে। ঋষি শ্রীঅরবিন্দের অনন্য অতিমানস সাধনার সূচনালগ্নে। যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে শাকপুরা গ্রামের দত্ত পরিবারের দু’সহােদর। শ্রীমােহিনী মােহন দত্ত ও শ্রী মনমােহন দত্ত ছিলেন অন্যতম। পিতা নিশি চন্দ্র দত্ত ও মাতা সুভদ্রা সুন্দরী দত্তের তিন সন্তানই শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমায়ের যােগাদর্শের সংস্পর্শে এসে সাধন জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তদানীন্তন শাকপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরে রেক্টর শ্রী মােহিনী মােহন দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “দেবস গ্রন্থাগার” এর বিভিন্ন তথ্য চিত্র হতে ইহা সুস্পষ্ট যে, তার সাথে শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমায়ের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অপর ভ্রাতা শ্ৰী মন মােহন দত্তকেও আলােকচিত্রে দেখা যায় অন্যান্য ভক্তদের সাথে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে আলাপরত অবস্থায়। এ দু’ভায়ের আস্পৃহাগ্নি সেদিন আলােকিত করেছিলাে চট্টগ্রামের একদল যুবাকে। দত্ত বাটী সংলগ্ন পশ্চিমের ভূতুরে বাড়ীটা “সাধন বাড়ী” নামে পরিচিতি পেয়েছিল, সেখানে সঙ্গোপনে বেড়ে উঠছিলাে ভবিষ্যতের শ্রীঅরবিন্দ দর্শনের সাধক যাদের অনেকেই পরে পন্ডিচেরী শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে গিয়ে স্থায়ী আশ্রমিকে পরিণত হন। এ সাধন বাড়ীতে প্রস্তুতি নিয়ে পরে শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে পৌছে যাওয়া পােপাদিয়ায় জন্ম নেয়া এক সাধিকা প্রমীলাদির “সাধন বাড়ী” গ্রন্থে এর ইতিহাসের টুকরাে ছবি পাওয়া যায় ।

শ্রীঅরবিন্দ
শ্রীঅরবিন্দ

শ্রীঅরবিন্দের ঘনিষ্ট সহচর শ্রী নীরদ বরণ এর ভাগ্নি শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের স্থায়ী আশ্রমিক ডলি মুৎসুদ্দি ও বাণী মুৎসুদ্দির মুখেও সম্প্রতি আমার পণ্ডিচেরী ভ্রমন। কালে শুনলাম “সাধন বাড়ীর” সেসব দিনের কথা। এ দু’বােন পণ্ডিচেরী যাবার পূর্বে চার মাস “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দিরে অবস্থানকালীন সাধক মােহিনী মােহন দত্তের এবং তার মাতা সুভদ্রা সুন্দরী দত্তের স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । সাধক কবি শী। সুধীর চৌধুরীও শ্রী মােহিনী মােহন দত্তের সান্নিধ্যে এসে ১৯৩৮ সালে পৌছে যান পণ্ডিচেরী শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বার বৎসর মা-শ্রীঅরবিন্দের স্নেহসান্নিধ্যে থেকে স্ব-গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথমে কধুরখীল নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-চক্র” ও পরে ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীঅরবিন্দ। সােসাইটি, চট্টগ্রাম কেন্দ্র। উল্লেখ্য, শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পণ্ডিচেরী হতে প্রকাশিত এক জার্নালে জনৈক সাধকের রচনায় শ্রীঅরবিন্দের এক উদ্ধৃতি পাওয়া যায়Chittagong is my best centre. শ্রীঅরবিন্দের জীবদ্দশায় এ উদ্ধৃতি প্রমাণ করে “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” তথা এ আশ্রমের গুরুত্ব – যা আমাদের জন্য এক। পরম আশীর্বাদ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অনেক সনাতনী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ন্যায় ঐতিহ্যমণ্ডিত এ আশ্রমটির উপরও কালাে ছায়া নেমে আসে। এক কুচক্রী মহলের কালাে থাবায় এ আশ্রম প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠাতা সাধক শ্রী মােহিনী মােহন দত্তের মৃত্যু হলে সরলপ্রাণ সাধক শ্রী মনােমােহন দত্তের পক্ষে সব বিষয় সম্পত্তি সঠিকভাবে সংরক্ষন করা সম্ভব হয়নি। দত্ত পরিবারের বিশাল সম্পত্তির প্রায় সম্পূর্ণটা বেদখল হয়ে যায়।

এমনকি ১৯৪৭ সালের ৬৩৩৬ সংখ্যক রেজিষ্টার্ড কবলামূলে শ্রীমতীসুভদ্রা সুন্দরী দত্ত কর্তৃক “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃমন্দিরের নামে দানপত্র মূলে অর্পন করা ১.৫৫ একর জমিরও বেশীর ভাগ বেদখল-জবর দখলে গ্রাস করে ফেলে। ১৯৮৪ সালে সাধক মনমােহন দত্ত পরলােকগত হলে। তাদের উত্তরাধিকার শ্রী চিন্তাহরন দত্ত, প্রকাশ চিন্ময় দত্ত (সাধক মনমােহন দত্তের। পােষ্য পুত্র) পরিবার পরিজন নিয়ে প্রায় অসহায় অবস্থার মধ্যে পতিত হন। এমনকি দত্ত পরিবারের ভিটি হতে তাদের সম্পূর্ণ উৎখাত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এসময় মােহিনী মােহন দত্তের স্নেহধন্যা সাধিকা আমার মাতা শ্রীমতী জ্যোৎস্নাময়ী চৌধুরী দত্ত পরিবারের বসত ভিটা রক্ষা ও প্রায় বিধ্বস্ত “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ।

খুব শৈশবে শ্রীমতী জ্যোত্সাময়ী চৌধুরী শ্রীমায়ের দর্শন পেয়েছিলেন এবং আজীবন মাতৃ-শরণে জীবন যাপন করে গেছেন। কধুরখীল পৈতৃক বাড়ীতে শ্রীঅরবিন্দ চর্চার মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেন। তখনই তিনি শ্রীমােহিনী। মােহন দত্তের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। বিবাহ সূত্রে পশ্চিম শাকপুরা গ্রামে ডাঃ শ্রী কালি শংকর চৌধুরীর ঘরণী হয়েও তিনি “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমােহিনী মােহন দত্তের সান্নিধ্যে শ্রীঅরবিন্দ দর্শন চর্চা চালিয়ে যান। তিনি প্রায়ই বলতেন, মােহিনী’দা তাকে বলেছিলেন, “তুই মাতৃ-মন্দিরে আসবি, তুই একলা আসলেই হবে”। শ্ৰীমতী জ্যোৎস্নাময়ী চৌধুরীও কথা রেখেছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগের দিন ও শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দিরে এসেছিলেন। আমৃত্যু এ প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কাজ করে গেছেন। ২০০৩ইং। সালে তার মৃত্যুর পূর্বে আমাকে সভাপতি ও শ্ৰী চিন্ময় দত্তের পুত্র শ্রী শিবু দত্তকে সম্পাদক করে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটি করে নবকলেবরে “শ্রীঅরবিন্দ মাত-মন্দির” সংস্কার, “শ্রীঅরবিন্দ মাত-মন্দির এডুকেশন এণ্ড কালচারাল সেন্টার” নামে শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র উদ্বোধন করে যান। যার বাস্তব রূপায়ন আজকের “মাদার একাডেমীর প্রথম বর্ষপূর্তি ও মােহিনী’দা প্রতিষ্ঠিত “দেবস লাগার” এর পুনঃচালুর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। .

“শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” সুরক্ষায় শ্রীমতী জ্যোৎস্নাময়ী চৌধুরী চট্টগ্রাম শ্রীঅরবিন্দ সােসাইটির সকল সদস্য/কর্মকর্তার আন্ত বিক সহযােগিতা পেয়েছিলেন। বিশেষতঃ অধ্যক্ষ শ্ৰী চিত্তপ্রসাদ তালুকদার, শ্রী নারায়ণ কষ গুপ্ত, প্রমুখের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন না পেলে “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” এর বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়া হয়তবা সম্ভব হত না। তাছাড়া সাধক মন মােহন দত্তের মৃত্যুর পর হতে এ আশ্রম এর অস্তিত্ব রক্ষায় যারা। শ্রীমতী জ্যোৎস্নাময়ী চৌধুরী ও আমাকে সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদান করে এসেছেন তাদের মধ্যে প্রাক্তন সম্পাদক শ্রী অমল দত্ত, প্রাক্তন সম্পাদক ও বর্তমান সহসভাপতি শ্রী স্বপন কুমার ঘােষ, হাবিলাসদ্বীপ নিবাসী শ্ৰী আশীষ সেন, প্রকৌশলী শ্রী রবিশংকর চৌধুরী, প্রকৌশলী শ্রী ঋষিকেশ চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযােগ্য।

এছাড়া এলাকাবাসী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্রী বাদল চন্দ্র দাশ সহ অনেকেই আমাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভাবে সহযােগিতা প্রদান করেছেন। বর্তমানে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদ “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃমন্দির” এর সার্বিক উন্নয়ন-সংস্কারে শুভানুধ্যায়ীদের সহযােগিতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ আশ্রম প্রাঙ্গন যাদের পদচারণায় বিভিন্ন সময় ধন্য হয়েছে তাদের মধ্যে অধ্যক্ষ শ্রী যােগেশ চন্দ্র সিংহ, অধ্যাপক শ্রী নগেন্দ্র লাল দে, শ্রীঅরবিন্দ সােসাইটি, পণ্ডিচেরী ভারতের যুগ্ম ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক শ্রী গােপাল ভট্টাচাৰ্য, শ্রীঅরবিন্দ সােসাইটি, বাংলাদেশ এর সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম জোয়ারদার, খুলনা শ্রীঅরবিন্দ সােসাইটির সভাপতি অধ্যাপক শ্রী অসিত বরণ ঘােষ, বগুড়া শ্রী অরবিন্দ সােসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ শ্ৰী বিপুল চন্দ্র রায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. এন.এইচ.এম আবু বকর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। অনেক চড়াই উত্রাই পেরিয়ে আজ আমরা এখানে এসেছি। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুখপত্র “নির্মাল্য” প্রথম বর্ষ-প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল। এও এক। নব সংযােজন। ইতিহাসর পৃষ্ঠায় আরও একটি উদ্যমী পদক্ষেপ। আসুক হাজারাে বাধা বিপত্তি। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি আলােকিত মানুষ গড়ার কেন্দ্র Living Institution এ পরিণত করে যাবাে “শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির” রূপী এ আশ্রমটিকে। “কথা নয় কাজ” । শ্রীমায়ের এ বাণী অনুসরন করে আমরা এগিয়ে যাব। ফলাফল যা। কিছু তা তাঁরই হাতে…।

সূত্র- নির্মাল্য – ১৩: শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দির শাকপুরা, বােয়ালখালী, চট্টগ্রাম। ১৬ ডিসেম্বর ‘০৯

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here