সুজিত সাহা ও দেবব্রত রায়,
রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর চট্টগ্রামে নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজও শেষ পর্যায়ে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে যান চলাচলের মাধ্যমে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বাংলাদেশ। তবে কর্ণফুলী নদীতে প্রতিযোগী একটি সেতু থাকায় টানেলের টোল হার নির্ধারণে সংশয়ে রয়েছে সেতু বিভাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল জনপ্রিয় করতে শুরুতে টোল তুলনামূলকভাবে কম রাখা হচ্ছে। এ কারণে টানেলের যানবাহন চলাচলে শাহ আমানত সেতুর চেয়ে আড়াই-তিন গুণ টোল আরোপ করতে যাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
টানেল প্রকল্পটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে টানেলের প্রবেশমুখের দূরত্ব বেশি হওয়ায় প্রাক্কলন অনুযায়ী যানবাহন চলাচলের বিষয়ে সন্দিহান সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১০ সালে মাত্র ৪৯০ কোটি টাকায় নির্মিত তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর (শাহ আমানত সেতু) টোল হার দেশের যেকোনো টোলযুক্ত সেতুর তুলনায় কম হওয়ায় টানেলের টোল নির্ধারণ নিয়ে জটিলতায় পড়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া এ উপমহাদেশে আর কোনো টানেল না থাকায় টোল হার কেমন রাখা উচিত সে বিষয়েও শুরু থেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল সেতু বিভাগ। তাই টোল নির্ধারণে নমনীয় অবস্থায় যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়।
২০ ডিসেম্বর টানেলের টোল হারের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর আগে কয়েক দফায় যানবাহনের টোল হার নির্ধারণ করলেও সেগুলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনঃপূত হয়নি। সর্বশেষ চলতি মাসের মাঝামাঝিতে সেতু কর্তৃপক্ষের গঠিত টোল সম্পর্কিত কমিটি নতুন একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে দেশের প্রথম টানেলের টোল হার চূড়ান্ত করা হবে। জানুয়ারির মধ্যে টানেলের টোল নির্ধারণ করতে সেতু বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
টোল হারের সর্বশেষ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শাহ আমানত সেতুতে প্রাইভেট কার ও জিপের টোল দিতে হয় ৭৫ টাকা। টানেল দিয়ে চলতে প্রাইভেট কার বা জিপ গাড়িকে গুনতে হবে ২০০ টাকা, যা শাহ আমানত সেতুর টোলের প্রায় আড়াই গুণ বেশি। পিকআপের জন্য শাহ আমানত সেতুতে টোল আগে ১৩০ টাকা হলেও নতুন করে টোল নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেখানে পিকআপের জন্য টানেলে টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। এছাড়া মাইক্রোবাস শাহ আমানত সেতুতে ১০০ টাকার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু টানেলে ২৫০ টাকা, বাস (৩১ আসনের কম) ৫০ টাকার বিপরীতে টানেলে ছয় গুণ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসনের বেশি) শাহ আমানতে ১৫৫ টাকার বিপরীতে টানেলে ৪০০ টাকা এবং বাস (৩ এক্সেল) শাহ আমানতে টোল নতুন নির্ধারণের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তবে বঙ্গবন্ধু টানেলের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০০ টাকা।
এছাড়া ভারী যানবাহন ট্রাক (৫ টন) শাহ আমানতে ১৩০ টাকার বিপরীতে টানেলে ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫.০১ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) শাহ আমানতে ২০০ টাকার বিপরীতে টানেলের জন্য ৫০০ টাকা, ট্রাক (৮.০১ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) শাহ আমানত সেতুতে ৩০০ টাকার বিপরীতে টানেলের জন্য ৬০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) শাহ আমানত সেতুর জন্য নতুনভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে টোল নির্ধারণের জন্য, আর টানেলের জন্য টোল হার ধরা হয়েছে ৮০০ টাকা। এছাড়া ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) শাহ আমানতে ৭৫০ টাকা টোলের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু টানেলে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেলের অধিক) শাহ আমানতে চলাচলের জন্য নতুনভাবে টোল হার নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ভারী যানবাহনটির জন্য বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল হার প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার টাকা, সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা ধরে মোট ১২ ধরনের যানবাহনের জন্য টোল হার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, টানেলের টোল হার নির্ধারণ/ পুনর্নির্ধারণে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সেতু কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সেতুগুলো, উড়াল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও টানেলের টোল হার নির্ধারণসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে দ্রুত সময়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। গত ১২ মে সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের (সেতু বিভাগ) উপসচিব মো. আবুল হাসান দ্রুত সময়ের মধ্যে টোল হার নির্ধারণের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রদানের নির্দেশনাও দেন। তবে কমিটি কয়েক দফা বৈঠকের পরও চূড়ান্ত টোল নির্ধারণ করতে পারেনি।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২৮ জুলাই টোল নির্ধারণ কমিটি বৈঠক করে টানেলের পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান শাহ আমানত সেতুর টোল হার দেখে দ্বিধায় পড়ে। যার কারণে সমীক্ষা অনুুযায়ী টানেল দিয়ে প্রাক্কলিত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে হলে টোলের পরিমাণ কোনোভাবেই বাড়তি রাখা যাবে না বলে মতামত দেন কমিটির সদস্যরা। শাহ আমানত সেতুর টোলের চেয়ে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ টোল নির্ধারণে ঐকমত্যে পৌঁছেন কমিটির সদস্যরা। তবে সে সময়ে টোল নির্ধারণের পরিমাণ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ওই সময়ে টানেল দিয়ে যানবাহনের আধিক্য ধরে রাখতে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রিহুইলারের মতো যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। তবে টানেলের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত এসব যানবাহন চলাচলের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না।
এদিকে ২০ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের এক জরুরি মিটিংয়ে নতুন করে বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল হারের খসড়া প্রস্তাব প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়। সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবুল হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেখা যায়, শাহ আমানত সেতুর বিদ্যমান টোল হারের আড়াই থেকে তিন গুণ (কয়েকটি খাতে টোল হার বেশিও রয়েছে) বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলে চলাচলকারী যানবাহনের টোল হারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নতুন টোলের প্রস্তাবে দেখা যায় মোট ১২ ধরনের যানবাহনের জন্য টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নতুন প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, থ্রিহুইলার চালানোর কোনো সুযোগ রাখা হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের শেষ মুহূর্তের নির্মাণকাজ চলছে। সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের সড়ক নির্মাণ প্রায় শেষদিকে। গত ২৬ নভেম্বর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রথম টিউবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলের একটি টিউব উদ্বোধন করা হলেও বিশেষায়িত প্রকল্প হওয়ায় যান চলাচলের জন্য পুরো উন্মুক্ত করা হবে কিছুদিনের মধ্যেই। গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ার আগেই টোল নির্ধারণ চূড়ান্ত করা হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশে বলা হয়েছে, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার। টানেলের পাশাপাশি প্রশস্ত ও সুবিধাজনক স্থানে কম টোল হারের সেতু থাকায় টানেলের ব্যবহার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে সেতু বিভাগ। টানেল নির্মাণে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ায় বিদ্যমান সেতুর সঙ্গে সমন্বয় করে টোল নির্ধারণের কারণে যথাসময়ে ঋণের অর্থ পরিশোধের চাপে পড়বে সরকার। এক্ষেত্রে টোল হার বাড়ালে যানবাহন কমে আয় আরো কমে যাওয়ার ভয়ে শুরুতে কিছুটা নমনীয় সেতু বিভাগ।
বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল নির্ধারণ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, টানেলের টোল হার নির্ধারণে শাহ আমনত সেতুর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। অতিরিক্ত টোল নির্ধারণ করলে টানেল দিয়ে গাড়ি যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। জোর করে যানবাহনকে টানেল ব্যবহার করাতে পারবেন না। যেখানে খরচ কম পড়বে সেদিক দিয়েই গাড়ি চালাবে মালিক পক্ষ। সেজন্য টানেলের চূড়ান্ত টোল হার শাহ আমানতের সঙ্গে বিবেচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে। টানেলের জন্য যানবাহন মালিকদের সহনশীল টোল হার নির্ধারণের পরামর্শ দেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (উন্নয়ন) মো. আবুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম। টানেলের টোল নির্ধারণে পাশের শাহ আমানত সেতুর সঙ্গে পর্যালোচনা করে একটি খসড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত কমিটির প্রস্তাব অর্থ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।’