অনুপম দেব কানুনজ্ঞ

‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করি, আওয়ামী লীগের না৷’ ছোটবেলায় খুব খটকা লাগতো৷ এটা কেমন কথা! বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি হয় না কিভাবে! সেই উত্তর ছোটবেলায় না মিললেও বড় হওয়ার পর মনে হয় উত্তরটা আমি নিজেই দিতে পারি৷

    
default

হ্যাঁ, শেখ মুজিবুর রহমান – বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠারও আগে থেকে রাজনীতি করতেন, এবং সেটা আওয়ামী লীগেরই রাজনীতি৷ কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, আরো তো অনেক নেতা ছিলেন, যারা সে সময় অভিজ্ঞতা, বয়স সবকিছুতেই শেখ মুজিবের চেয়েও অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন৷

তাহলে শেখ মুজিব কি করে হঠাৎ করে বাঙালির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠলেন? কারণ, বাংলার মানুষ কী চায়, কিভাবে তা আদায় করতে হবে তা সঠিক মুহূর্তে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন একমাত্র তিনিই৷ নীতি-আদর্শের সংগ্রামে অন্য দল তো বটেই, নিজ দলের নেতাদের চেয়েও যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন তিনি৷

নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়, বড় হওয়ার পথে আশেপাশে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই পেয়েছি৷ সুবিধা পাবেন জেনেও অনেকেই সার্টিফিকেট নেননি, কারণ তাঁরা মনে করতেন দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ তাঁরা সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য করেননি৷ বিভিন্নভাবে তাদের স্মৃতিচারণ কাছ থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছে৷ তাদের কাছ থেকেই শোনা, ‘কিছু একটা হতে যাচ্ছে’ এমন তথ্য বঙ্গবন্ধুর কাছেও একাধিকবার এসেছিল৷ কিন্তু ‘বাঙালি আমার কিছু করতে পারে না’ এমন মনোভাব সবসময়ই ছিল তাঁর৷ মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তিনি মানতে পারেননি, বাঙালিরাই তাঁকে হত্যা করবে৷

Sheikh Mujibur Rahman Flash-Galerieবাঙালি তাঁর ক্ষতি করতে পারে – বিশ্বাস করতেন না বঙ্গবন্ধু

যুদ্ধ হলো, দেশও স্বাধীন হলো৷ ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১৷ গৌরবময় ইতিহাসের জন্ম দিয়েও মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ঘটনাটির কালো দাগ থাকল আমাদের নিজেদের কপালেই৷ স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মাথায় সপরিবারে স্বাধীনতার মূল ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিটিকে হত্যা করাটা যেমন নৃশংস, হত্যার বিচার করা যাবে না, খোদ সংবিধানে এমন ভয়ংকর কালাকানুন জারি করাটা তার চেয়েও নৃশংসতম৷

১৯৭৫ সালের পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই স্রোতের উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে বাংলাদেশ৷ ইতিহাস থেকে একসময় বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও, সে ইতিহাস আবার ফিরে এসেছে৷ কিন্তু আলোচনাটা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি নিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি৷ বিরোধী পক্ষের বঙ্গবন্ধুকে ‘বিতর্কিত করার’ রাজনীতি তো আছেই, খোদ আওয়ামী লীগেরও ‘চর্বিত চর্বন’, ‘অতিকথন’ এবং ‘অপপ্রয়োগ’ এই রাজনীতিতে মারাত্মক ভূমিকা রাখছে ৷

স্বাধীনতার পর থেকে স্বভাবতই পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব তো আছেই, পাশাপাশি বাংলাদেশে ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক নানা কারণেই ভারতবিরোধী মনোভাবও প্রবল হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু নিজের জন্মকে অস্বীকার করছে, এমন উদাহরণ কিন্তু এই দুই দেশেও নেই৷

‘কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন৷ তিনি মুসলিম লীগ করতেন৷ কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতার পালা বদল হলেও কখনও জিন্নাহকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা বা তাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়নি, বা তার প্রয়োজনও পড়েনি৷ জিন্নাহর পর দীর্ঘদিন মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ, এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি শক্তিশালী বিরোধীতা সৃষ্টি করলেও, সে আঘাত জিন্নাহর ওপর পড়েনি৷ মুসলিম লীগও জিন্নাহকে ‘নিজেদের’ করে নিয়ে বিশেষ সুবিধা আদায়ের চেষ্টার দিকে যায়নি ৷

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ নিয়ে বিতর্ক চলছে, আরো অনেকদিন চলবে ৷ কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কালিমা লেপনের মতো ঘটনা জঙ্গিবাদে, সেনা অভ্যুত্থানে বিপর্যস্ত একটি দেশেও ঘটেনি৷

ভারতে ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাসও অনেকটাই উল্লেখযোগ্য৷ দীর্ঘদিন (প্রায় ৩০ বছর) ক্ষমতায় থাকার পর জাতীয় কংগ্রেসের পতন ঘটে, ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টি৷ ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সুভাষ বসুর সহিংস পন্থা ঠিক ছিল, নাকি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন, এ নিয়ে বিতর্ক আছে৷ নেহেরু চাইলে ভারতবর্ষ এক রাখতে পারতেন কিনা, সেই নিয়েও আছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা৷ কিন্তু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতে থাকলেও পরবর্তীতে জাতীয় এই নেতাদের বিতর্কিত করে ইতিহাসকেই হুমকির মুখে ফেলা দেয়ার চেষ্টা বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও হয়নি ৷

হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিসিদ্ধান্তের নানা সমালোচনা থাকলেও কখনই সেটা রাষ্টীয়ভাবে কালিমালেপনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি৷ হত্যাকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ারও চেষ্টা করা হয়নি ৷

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই দশকে নানাভাবে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে৷ হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা স্বভাবতই বুঝতে পেরেছিল, তীব্র প্রতিবাদ না হলেও, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ঠিকই রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়৷ ফলে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে বঙ্গবন্ধু এবং ইতিহাস বিকৃত করা ছাড়া উপায় ছিল না ৷

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব চেয়ে কাছের মানুষ ছিল খন্দকার মোস্তাক,এতো স্নেহ পাওয়ার পরেও সেই বেঈমানি করতে পরলো, উনি সেই খুনি মোস্তাক ।
View image on Twitter

স্বাধিকার আন্দোলনের পর থেকে, স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে যেমন সমাজ গঠনের পথে এগোচ্ছিল, হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ঠিক তার উলটো পথে যাত্রা শুরু করে৷ যারা এতোদিন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরোধিতা করেও সুবিধা করতে পারছিল না, তারাই হঠাৎ হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্র৷

১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ ৷ বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা প্রতিহত করতে শুরু হয় ইতিহাস পুনর্লিখন ৷ কিন্তু সেই পুনর্লিখন আর শুধু পুনর্লিখনের পর্যায়ে থেমে থাকেনি ৷ বিপ্লবী চে গুয়েভারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন৷ অথচ মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে তিনি নিজেই হয়েছেন ব্যবসার অন্যতম পণ্য ৷

একই অবস্থা সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও ৷ সারা জীবন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু ৷ অথচ তার দলের নেতারাই এখন তাকে সরিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৷ একসময় বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ সাহেব’, ‘শেখের বেটা’ ‘শেখের পো‘ এবং শেখ হাসিনাকেও ‘শেখের বেটি’ বলে সম্বোধন করার লোক অনেক ছিল ৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ মুজিব’ বলার অপরাধে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, এমন ঘটনাও ব্যক্তিগতভাবে জানা আছে ৷

শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ করায় একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার ঘটনাও তো আমাদের জানা ৷ সেই আওয়ামী লীগ নেতাও অনেকের মতোই মনে করেছিলেন, অন্য কোন বিষয়ের চেয়ে ‘বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হয়েছে’ অভিযোগটাই বেশি যুৎসই হবে৷ এমন চিন্তা পুরো আওয়ামী লীগ জুড়েই বর্তমান ৷

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে শুধু জাতির নয়, নিজের পিতা হিসেবেও অন্য মর্যাদায় দেখে থাকেন ৷ আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ‘চোখে পড়ার’ মতো করে নিজের উন্নতিতে বঙ্গবন্ধুকে দৃষ্টিকটুভাবে কাজে লাগানো এখন দেশজুড়ে হরদম ঘটে চলেছে ৷

নিজেদের সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধুর ‘সৈনিক’ প্রমাণে যে পরিমাণ তোড়জোড় ইদানীং দেখা যায়, সে পরিমাণ উৎসাহ নিয়ে তার আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে দেশের উন্নতি আরো দ্রুত হওয়ারই সম্ভাবনা ছিল৷ এই ‘সৈনিকদের’ বেশিরভাগই আবার জানেনও না বঙ্গবন্ধুর আদর্শটা কী ছিল৷

একাধিক ক্ষেত্রে আদর্শের কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তরটা ‘সোনার বাংলা গড়া’ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ৷ অথচ কথায় কথায় ছয় দফার উল্লেখ করলেও অনেকে এখনও জানেনই না, ছয় দফার দফাগুলো আসলে কী ছিল৷ ফলে এমন ‘সৈনিকদের’ মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম মাঝেমধ্যেই অন্যদের বিরক্তির কারণ হয় বই কি!

Sheikh Mujibur Rahman Flash-Galerieবাংলার মানুষের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

স্বাধীনতার ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে সাধারণের কাছে তুলে ধরার বদলে আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ‘সৌল এজেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে ব্যস্ত৷ একসময় ‘জয় বাংলা’ ছিল স্বাধীনতাকামী মানুষের স্লোগান, ধীরে ধীরে তা আওয়ামী লীগের স্লোগানে পরিণত হয়৷ এতে আওয়ামী লীগ খুশি হয়, কিন্তু কেন হয়, জানি না৷ দীর্ঘদিন পর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে সাধারণ মানুষের কণ্ঠে আবার ফিরে এসেছিল ‘জয় বাংলা’৷

বঙ্গবন্ধুকেও সাধারণ মানুষের কাছে ফিরতে দিন৷ আগেও যারা বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের ‘কুক্ষিগত’ করে রাখতে চেয়েছিলেন, তারাই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ঠিকই রয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছাপ৷

আবারও বলতে হয় ৭ই মার্চের ভাষণের কথা৷ বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন, ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি৷ আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন৷’ অথচ এখন প্রতিটি বিষয়েই নেতারা এমনভাবে বক্তব্য দেন, শুনতে মনে হয়, ‘আপনারা কিছু জানেন না, বোঝেনও না৷ আপনারা শুনুন, আমরা বলি৷’

যে সাধারণ মানুষকে বঙ্গবন্ধু এত ভালোবাসতেন, তাঁদের কাছেই তাঁকে ফিরতে দিন৷ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা যত কুক্ষিগত করে রাখতে চাইবেন, ততই সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরে যাবেন৷ আলোচনার লক্ষ্য হোক বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি নয়৷

Anupam Deb Kanunjna DW-Bengali Service (Privat)

 লেখক- অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে, প্রথম আলোর সৌজন‌্যে

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here