বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
১৯৭৬ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ প্রদান করে সামরিক শাসকরা। কিন্তু একইসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করা যাবে না। এমনকি তাঁর নাম পর্যন্ত নেওয়া যাবে না। ৫ আগস্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটি সামরিক ফরমান জারি হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলবিধি (সংশোধনী) ১৯৭৬ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে : ‘জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোন প্রকার ব্যক্তি পূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার অথবা বিকাশ’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
এ ধরনের নির্দেশ জারির একটিই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, উদ্দেশ্য সামনে রেখে কোন রাজনৈতিক দল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসিত রাখার জন্যই জিয়াউর রহমানের এ ঘৃণ্য অপচেষ্টা, সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না।
এ অবস্থাতেই আসে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মেলানো রাজনৈতিক অপশক্তির কাছে এটা ছিল ‘নাজাত দিবস’। ঘরোয়া রাজনীতির চালু হলেও বঙ্গবন্ধুর কথা বলা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধের সাহস ও গৌরবগাঁথা বলা যাবে না। শোকের এ দিবসটি উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় ছাত্রলীগের প্রধান দুটি কর্মসূচি নির্ধারিত হয় এভাবে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ অনুষ্ঠান। বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে এ দুটি অনুষ্ঠানে কোনা না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট করতে হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মিছিল নিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ যেতে দেবে না, সেখানে কোনো সমাবেশ করা যাবে না সে বিষয়টি জানা ছিল। এ কারণে ছোট ছোট দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের দুই ছাত্রনেত্রী বঙ্গবন্ধু ভবনের ফটকে শাড়ির আচলে লুকিয়ে রাখা তাজা ফুল রেখে নীরবতা পালন করেন। কিন্তু ক্রমে পুলিশ উপস্থিতি বাড়ানো হয়। ৩২ নম্বর সড়কের কোনো প্রান্ত দিয়েই কাউকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যেতে দেওয়া হয় না। কন্ট্রোল রুম থেকে দ্রুতই নির্দেশনা যায় মিরপুর সড়ক. ধানমণ্ডি লেক কিংবা আশপাশের এলাকা, যে যেখানে পারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। কিন্তু তাতেও বাধা আসে। ছাত্র দেখলেই পুলিশ তাড়া করে।
কিন্তু কোনো নির্যাতনই জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে ছাত্রসমাজকে বিরত রাখা যায়নি। রাস্তায় নেমে ফুল দিতে বাধা আসায় অনেকে বাসের জানালা দিয়ে ফুল ছুঁড়ে দেয় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে। ধানমণ্ডি লেকের পানিতেও ভেসে বেড়াতে তাকে নানা রংয়ের ফুল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করায় তিনি উপস্থিত থাকতে সম্মত হন। তবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত পরিচালনা যে ঝুঁকিপূর্ণ সেটাও তিনি বলেছিলেন। এ কর্মসূচির নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রসমাজ এগিয়ে যায় এ শিক্ষা তো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই পাওয়া।
জাতির পিতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে একটি বাক্যও লেখা হয়নি। এর পেছনে ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশ। তারা চেয়েছে মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে দিতে। কিন্তু তাকে মুছে ফেলা যায়নি। কখনও যাবে না। মানুষের মনে তাঁর স্থান সুদৃঢ় ও স্থায়ী। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত শিরে এগিয়ে যাওয়ার, একটির পর একটি সমৃদ্ধির সোপান অতিক্রম করার প্রেরণা হয়ে আছে তিনি, থাকবেনও।