প্রচারের কাজ কার? লেখকের নাকি প্রকাশকের—বাংলাদেশে বইমেলা এলেই এ নিয়ে বিতর্কটা তুঙ্গে ওঠে। একশ্রেণির অকাট্য মত, লেখকের কাজ শুধু লিখে যাওয়া, ক্যানভাসার হওয়া তাঁর কাজ নয়। এ কাজ পুরোপুরিই প্রকাশকের। আরেক শ্রেণির যুক্তি, প্রযুক্তির এই তুঙ্গস্পর্শী সময়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখাটা বোকামি। নিজের লেখা প্রচারের দায়িত্ব কিছুটা লেখকদের নিজেরই কাঁধে নেওয়া উচিত।
এই সব মতবিরোধের মধ্যেই গুগল ঘাঁটতে গিয়ে জানা গেল, প্রচারের কাজ লেখক ও প্রকাশকের উভয়েরই। তবে তাঁদের প্রচারের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাত রয়েছে। মার্কিন লেখক ও টেডএক্স বক্তা তরিয়া ভিশন অ্যাভান্ট বলেন, বই একটি পণ্য, তাই পণ্যটি বিক্রি করার জন্য সব ধরনের বিপণন কৌশল ব্যবহার করবেন প্রকাশক। এর মধ্যে প্রচার বা মার্কেটিং বিষয়টিও অবধারিতভাবে থাকবে। অন্যদিকে লেখক তাঁর নিজের ‘ব্র্যান্ড’ তৈরি করবেন।
বাইরের দেশে লেখক ও প্রকাশকেরা এই দুই কাজের সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু ধরতে পারলেও আমাদের দেশের লেখক ও প্রকাশকেরা কার কী কাজ, অনেক সময়ই তা বুঝতে পারেন না। ফলে দেখা যায়, এই সময়ের তরুণ লেখকেরা শুধু রাত-দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইয়ের প্রচার চালান। আর অন্যদিকে হাতে গোনা দু-চারজন প্রকাশক ছাড়া বেশির ভাগেরই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
যেভাবে প্রচার চালাতে পারেন প্রকাশকেরা
কোনো একটি বই প্রকাশের আগে প্রকাশকদের উচিত ওই বইয়ের আধেয় বা কনটেন্ট সম্পর্কে বাজার জরিপ করা। বাজারে বইটির চাহিদা কেমন, কোন শ্রেণির পাঠক এটি কিনতে পারেন, তাঁদের আনুমানিক সংখ্যা কত ইত্যাদি জানার জন্য জরিপ করা প্রয়োজন। এসব কাজের জন্য বিদেশের বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে থাকে। অথবা স্বাধীন গবেষক ও জরিপকারী কোনো দলকে দায়িত্ব দেয়।
জরিপের ফল যদি ইতিবাচক আসে, তখন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করেন প্রকাশকেরা। এরপর বই লেখা হয়ে গেলে প্রকাশক বইটির বিপণনে নামেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশের বেশির ভাগ প্রকাশক কোনো একটি মার্কেটিং কোম্পানিকে ভাড়া করেন। তারা তখন বইটির ‘টার্গেট অর্ডিয়েন্স’ বা সম্ভাব্য পাঠক কারা, তাঁদের কাছে কীভাবে বইটির খবর পৌঁছে দেওয়া হবে, কীভাবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হবে—এসব নিয়ে কাজ করেন।
এক-দুটি ব্যতিক্রম বাদে আমাদের দেশে প্রকাশকদের মধ্যে এ ধরনের চর্চার ছিটেফোঁটাও নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা কেবল বই ছেপেই হাত গুটিয়ে বসে থাকেন এবং বলেন যে ‘বই বিক্রি হয় না।’ তবে অন্যান্য দেশের গবেষণার সাপেক্ষে এ কথা বলা যায়, আমাদের এখানে অনেক প্রকাশকই জানেন না যে কার জন্য তিনি বইটি ছেপেছেন এবং কার কাছেই-বা বিক্রি করবেন।
উন্নত দেশের প্রকাশকেরা প্রচারের জন্য বইয়ের বিলবোর্ড, পোস্টার, স্যুভেনির, কমার্ক, কলম, ডায়েরি, বইয়ের প্রচ্ছদ-সংবলিত টি-শার্ট, মগ ইত্যাদি তৈরি করেন। বইয়ের আলোচকদের মাধ্যমে পত্রিকায় আলোচনা ছাপান। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন। লেখকের সঙ্গে ‘বুক সাইনিং ইভেন্ট’, ‘রয়্যালটি গিভিং প্রোগ্রাম’, বইয়ের প্রি-অর্ডার, লেখকের জন্মদিনে বিশেষ মূল্যছাড়, বই নিয়ে ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা, রিভিউ প্রতিযোগিতা, ভিডিও প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করে থাকেন। এ ছাড়া এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপ্তি ও বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে সরব হয়েছে। এসব মাধ্যমে বছরজুড়ে বিজ্ঞাপন দেয় তারা।
আশার কথা, আমাদের দেশের দু-একটি বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ইদানীং ফেসবুকে সরব হতে দেখা যাচ্ছে। বই নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার তৈরি করে তারা পোস্ট দিচ্ছে, ভিডিও পোস্ট করছে। এই বইমেলার মৌসুমে কোনো কোনো প্রকাশনীকে ফেসবুকে ‘পেইড বিজ্ঞাপন’ চালাতেও দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ডিজিটালি রাইট’ গত ডিসেম্বরে জানায়, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স গত এক বছরে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনবাবদ ৭ হাজার ২৯২ ডলার ব্যয় করেছে। অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হিসাব জানা যায়নি।
এ থেকে আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে আমাদের দেশের প্রকাশকেরা বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগী হবেন। অযাচিতভাবে লেখকদের ‘বইয়ের ক্যানভাসার’ হতে বাধ্য করবেন না।