সাংবাদিক ছিলেন। গবেষণা করেন। বই আছে অনেক। একটি প্রকাশনীরও মালিক। চট্টগ্রাম বইমেলাতে অনেক অবদান আছে তার। এই ভিন্ন গল্প লিখেছেন জাহেদুল হক
জামাল উদ্দিনের জন্ম ১৯৫৯ সালে ৮ মে। চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার শিলাইগড়া গ্রামে। বাবা কবির আহমেদ, মা মোস্তফা বেগম। পরিবারটি প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করেন। অনেক আত্মীয়, গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশীরা বাম রাজনীতিতেও যুক্ত। এই মানুষদের সঙ্গে মিশে অনুপ্রাণিত হয়েছেন জামাল। তাই আনোয়ারা সদরের ‘আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’-এ পড়ার সময় থেকে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলের কিশোর। বারুদ, রক্তের একাত্তর; সশস্ত্র সংগ্রাম খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেই সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের গোলাবারুদ বয়েছেন। চট্টগ্রাম শহর থেকে উপজেলায় জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা মানুষদের নানাভাবে সেবা করেছেন। তাদের জীবন, সম্পত্তি রাতদিন পাহারা দিয়েছেন। কিশোর বয়সেই মনে মুক্তিযুদ্ধ মিথ হয়ে গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তার শুভ কাজের মূল প্রেরণা। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করেছেন। পরে আনোয়ারা কলেজে পড়তে পড়তে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা, দক্ষিণ ছাত্রলীগ সহ-সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতির কাজ করেছেন। তবে এই দিনগুলো কাঁকরে মেশা ছিল। আঘাত, প্রতি-আঘাত; বাধা পেরিয়েছেন। অজ্ঞানতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতে ১৯৮১ সালে সাংবাদিকতা শুরু, ‘বাংলার বাণী’তে। চাকরি করেছেন ‘সেবক’, ‘ইনকিলাব’, ‘রূপালী’, ‘আজকের কাগজ’ নামের দৈনিকগুলোতে। স্টাফ রিপোর্টার থেকে চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ছিলেন। ২০০২ সালে আজকের কাগজের ব্যুরো প্রধান ছিলেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কালো বাণিজ্যের বিরুদ্ধে তার কটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আছে। ছোট কাগজ ‘নন্দন’, শিশু পত্রিকা ‘ঘুড়ি’র সম্পাদনা করেছেন। সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘বলাকা’র প্রধান সম্পাদক ছিলেন ১২ বছর। এখন চট্টগ্রামের পাক্ষিক ‘চট্টলচিত্র’র সম্পাদক। সৃজনশীল প্রকাশনা ‘বলাকা’র মালিক।
বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে পড়ালেখা করতে পারেননি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে খুব ভালোবাসেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, গবেষক ড. আবদুল করিম, ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর কাছাকাছি এসেছেন। তাদের কাছে ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শিখেছেন। বই থেকে নয়, নিজে এ খোঁজে গিয়েছেন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, কলকাতা ও দিল্লি। বৈধ, অবৈধ, জীবনের ঝুঁকি কোনোকিছুর পরোয়া করেননি। মিয়ানমারে নাসাকা বাহিনীর হাতে ধরা খেয়ে জেল খেটেছেন। এ পরিশ্রমে তার গবেষণায় তৈরি হয়েছে গবেষণা নিবন্ধ ও মূল্যবান গ্রন্থ।
তার লেখা আলোচিত দুই খণ্ডের গবেষণা বই–‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস- আদিকাল (২০০৬)’, ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস- আধুনিককাল (২০০৬)’। আনোয়ারা উপজেলার ইতিহাস নিয়ে লেখা বই দুটি আলোচিত হয়েছে। লিখেছেন–‘চট্টগ্রামের ইতিহাস : জনবসতি, নামকরণের যৌক্তিকতা, কাল নির্ণয় ও পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৯)’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস (২০১১)’, ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম : মাস্টারদা সূর্য সেন ও সূর্যসাথীরা (২০১১)’, ‘আনোয়ারা : একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১১)’, ‘বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম (২০১২)’, ‘মোগল সাম্রাজ্যের বিলুপ্ত অধ্যায় : দোহাজারী (২০১২)’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমাজাতি (২০১৩)’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর (২০১৩)’, ‘শ্বাশত চট্টগ্রাম (২০১৫)’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (২০১৬)’, ‘বাংলা আমার মা : বাঙালি, বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৬)’, ‘কর্ণফুলীর পালতোলা নৌকা ‘জননেতা আলহাজ মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর আত্মজীবনী (২০১৬)’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (২০১৬)’, ‘লুণ্ঠিত আরাকানে রোহিঙ্গা জাতির আর্তনাদ (২০১৭)’, ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য (২০১৭)’। সম্পাদনা করেছেন ‘হুমায়ুন আজাদ : এই বাংলার সক্রেটিস (২০০৬)’, ‘বিশ্বজনীন বাঙালি ড. কামাল হোসেন (২০০৪)’, ‘কালজয়ী পুরুষ জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম (২০০৪)’, ‘ভাষাবিদ ও অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের শেষ সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য (২০০৫)’, ‘চট্টগ্রামের নারী লেখক (২০০৫)’, ‘অন্তরঙ্গ কথোপকথন (২০০৬)’।
চারশর বেশি লেখা লিখেছেন পত্র-পত্রিকা ও জার্নালে। সামনে বেরুবে– ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম-আরাকান’, ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস : প্রাচীন কাল’, ‘মোগল সাম্রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস’, ‘কক্সবাজারের ইতিহাস’, ‘বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রাম : আরাকান’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মারমা জাতি’, ‘দুনিয়া কাঁপানো জলযুদ্ধ : অপারেশন জ্যাকপট’, ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থানের নামকরণ’ ইত্যাদি আরও কয়েকটি গ্রন্থ।
২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন প্রকল্প’র গবেষক। নামকরা প্রতিষ্ঠানের হয়ে চট্টগ্রাম জেলা শহরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পুরো পূর্ব পাকিস্তানের নদীবন্দরগুলোতে নৌ-কমান্ডোদের অপারেশন জ্যাকপট গবেষণা করেছেন।
এখন তাদের পুরো চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় অন্যতম কর্মী। তার বইগুলোতে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা, গণহত্যা আছে। তিনি অনেক গণহত্যা, গণকবর নিজে খুঁজে বের করে লিখেছেন। প্রকাশকদের সংগঠন ‘সৃজনশীল প্রকাশন পরিষদ’ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক। ইতিহাস পরিষদ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। এ বিভাগের প্রকাশনা শিল্প তার জানা। ভূমিকা আছে। বলেন, ‘ব্রিটিশ ভারতের সাহিত্যের বইগুলো পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা ও আমাদের চট্টগ্রাম থেকে বেরুত। দেশভাগের পর সব ওলট-পালট হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার বাংলাবাজারকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠতে লাগল। তাতে ধুঁকে ধুঁকে মরতে লাগল আমাদেরটি। স্বাধীনতার পর বইমেলা বাংলা একাডেমিতে শুরু হলো। বিশাল মেলাটি রাজধানীতে হয়। তবে পুরো দেশের সব সাহিত্যপ্রেমী ও কর্মীরা আসতে পারেন না। আসতে তাদের অনেক টাকা খরচ, ভোগান্তি সইতে হয়। এজন্য চট্টগ্রামে আলাদাভাবে ২০০৭ সাল থেকে ১৩ বছর ধরে আমরা সৃজনশীল প্রকাশন পরিষদ শহরের মুসলিম হলের সামনের খোলা জায়গায় প্রতি বছর একুশের বইমেলা করছি। দলাদলি ও স্বার্থপরতা আমাদের এখানে আছে। আন্দরকিল্লার বইয়ের দোকানগুলোর বই নিয়ে আরও কটি আলাদা বইমেলা স্বার্থপররা করেন। তাতে সবার ক্ষতি। চট্টগ্রামের বইমেলা পূর্ণ মেলা হতে পারছে না।’
তা দূর করতে তারা কাজ করছেন।
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মনজুর আলম উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সবার একটি বইমেলা শুরু করলেন। তারপরও কাজটি বন্ধ করা যায়নি। আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র হওয়ার পর পরিষদ সৌজন্য সাক্ষাৎ করল। বিচ্ছিন্ন বইমেলাগুলো নিয়ে কথা বলেছি। ২০১৮ সালে আমাদের বইমেলা উদ্বোধন করতে এসে মেয়র বক্তৃতায় একটিই মেলার ঘোষণা করলেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই মেলা করতে অনুরোধ করলেন। ঢাকা থেকে অন্তত ২৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলাম।’ তারপর কী হলো– ‘বাংলা একাডেমির বিশাল বইমেলা ছেড়ে রাজধানীর প্রকাশনীগুলো আসতে চাইল না। তারপরও খাটতে লাগলাম। ফলে গত বছর বইমেলায় ঢাকার ৫০টি, চট্টগ্রামের ১০০টি প্রকাশনী স্টল দিল আমাদের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামের চত্বরে।’
এভাবে তার উদ্যোগে, সবার সাহায্যে চট্টগ্রামে একটি ভালো বইমেলা শুরু হলো। ঢাকাসহ সারা দেশের পত্রিকা, টিভি, রেডিও, অনলাইন গণমাধ্যম মেলাটি দ্বিতীয় বড় বইমেলা হিসেবে কভার করল। মেলায় ১৮ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের একুশে বইমেলা উদ্বোধন করেছেন প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বলেছিলেন, এই মেলাকে স্থায়িত্ব দিতে বড় পরিসরে করতে হবে। মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও বলেছেন। ফলে তারা সবাই মিলে এবারের এই বইমেলা দ্বিগুণ বড় জায়গায় করছেন। এবার ২০৬টি স্টল আছে। নতুনভাবে বইমেলার নীতিমালা ও নিয়মাবলি তৈরি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মেলার নাম রেখেছেন ‘মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম ২০২০’। ঢাকার ১২৮টি প্রকাশনী আছে। অন্যায় করে এমন প্রকাশকদের স্টল দেননি। তিনি মেলা কমিটির যুগ্ম সচিব।
বললেন তার প্রকাশনার অভিজ্ঞতা–‘বইমেলা ঘিরে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মহাব্যস্ত পুরো দেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প। এবার চীনের করোনাভাইরাসে আমাদের কালি, কাগজ, প্লেটসহ বেশিরভাগ দ্রব্যাদির দাম অনেক বেড়েছে। এখনো চীন থেকে আমদানি করা হয় আমাদের প্রায় সব উপকরণ। এতদিনেও দেশের নিজস্ব মুদ্রণ ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। কেউ এগিয়ে আসেননি। তবে মরণ ভাইরাসে আমদানি কমেছে। তাতে বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। প্রতি ফর্মা ছাপা খরচ বেড়েছে ১৫০ থেকে ২শ টাকা। অনেক লেখক তাদের টাকা দিয়ে বই ছাপাতে পারছেন না।’